বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের প্রথম দ্বি-বার্ষিক সন্মেলন ২০২৩-এ পঠিত মূল প্রবন্ধ
শ্যামল দত্ত
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাষায় বিদ্যাসাগর ছিলেন ”সিদ্ধ”পুরুষ। শুধু সিদ্ধ নয়, পরমহংসের বর্ণনায় তিনি ছিলেন স্বত:সিদ্ধ। দেখা করতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে তিনি বলেছিলেন “সিদ্ধ তো তুমি আছই।”
বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন, ‘মহাশয়, কেমন করে?’ শ্রীরামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, “আলু পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়, তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া!”
এ জগতে সিদ্ধিলাভ কয়জনের হয়? বিদ্যাসাগর সকল অর্থেই সিদ্ধ ছিলেন। নি:স্বার্থ দান ও মানবকল্যাণ ব্রতের ফলে তৎকালীন বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। কোলকাতার সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু ল কমিটির দেয়া “বিদ্যাসাগর” উপাধি’র অগাধ সলিলে তার পৈত্রিক “বন্দ্যোপাধ্যায়” উপাধিটি প্রায় হারিয়ে গেছে।
’চারিত্রপূজা’ গ্রন্থে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “তাহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।” তার হাত দিয়েই বাংলা ভাষা মুক্তি লাভ করেছিল। শৈশবে আমরা যে বাংলা বর্ণমালা শিখেছি, যে বর্ণমালায় আমাদের প্রতিদিনের বিদ্যাশিক্ষা চলছে তা বাংলায় এসেছে তারই হাত ধরে। তিনি ব্যাকরণ দিয়েছেন, বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করেছেন এবং সর্বোপরি বহু বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন; যার মধ্যে ২৮০টি ছিল মেয়েদের বিদ্যালয় – যে যুগে পুরুষেরই শিক্ষা নেই – তখন মেয়েদের বিদ্যালয়ে পঠনের পথ তৈরি। এই সবকিছু পিছনে রেখে এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার তথা নারীমুক্তি আন্দোলন নিয়ে – যে পথ ধরে আজ আমাদের মুক্তির নবতর অন্বেষা।
নারীর উন্নয়ন তথা নারীমুক্তি এবং সমাজের উন্নয়ন তথা সমাজের মুক্তির জন্য তার সেকালের লড়াই এবং প্রতিবন্ধকরা নতুন করে হাজির হয়েছে হিন্দু আইন সংস্কারে আমাদের আজকের আন্দোলন এবং প্রতিবন্ধকদের রূপ নিয়ে।
বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে বিদ্যাসাগর তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ বলে দাবি করে গেছেন। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে প্রথম একটি বই প্রকাশ করেন। সমাজে, বিশেষত: পণ্ডিত মহলে হুলুস্থুল পড়ে যায়। রবিন্দ্রনাথের ভাষায়, “যখন তিনি বালবিধবাদের দুঃখে ব্যথিত হইয়া বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেন তখন দেশের মধ্যে সংস্কৃত শ্লোক ও বাংলা গালি-মিশ্রিত এক তুমুল কলকোলাহল উত্থিত হয়।”
এরপর অক্টোবর মাসে তিনি বিরোধীদের যুক্তির জবাবে পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ দ্বিতীয় বইটি প্রকাশ করেন। বৈঠকের পর বৈঠক, বিতর্ক, গণসংযোগ করে সমাজের বিশিষ্টজনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে গণস্বাক্ষর নিয়ে বৃটিশ সরকারের কাছে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করার জন্য আবেদন পত্র পাঠান। তখন মরা গাছে ফল আসে। ইংরেজ সরকার ১৮৫৬’র ২৫ জুলাই Hindu Widow’s Re-marriage Act, 1856 পাশ করে। ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধের পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় সংস্কার। রবিন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মুষলধারে শাস্ত্র ও গালি-বর্ষণের মধ্যে এই ব্রাহ্মণবীর বিজয়ী হইয়া বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করিলেন এবং তাহা রাজবিধিসম্মত করিয়া লইলেন।”
রক্ষণশীল পণ্ডিতদের যুক্তি খণ্ডাতে গিয়ে বেদ, পুরাণ ও স্মৃতি শাস্ত্র থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা বের করে দেখালেন বিদ্যাসাগর। পরাশর সংহিতা বলছে,
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধিয়তে।”
অর্থ: স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়) ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় – এই পাঁচ প্রকার বিপদ উপস্থিত হয় তবে নারীর জন্য অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়।
এখানে স্বামী মারা গেলে নারীকে অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধিসম্মত (পতিরণ্যো বিধিয়তে) বলা হয়েছে। আরও অনেক শাস্ত্রেই এরকম নির্দেশ আছে। কিন্তু তবুও তৎকালীন হিন্দু সমাজের কথা – এক নারীর দুই স্বামী হতে পারে না, তাহলে সতীত্ব বলে কিছু থাকেনা, মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়, হিন্দু বিয়ে জন্মজন্মান্তরের বন্ধন ইত্যাদি।
সেকালে বিদ্যাসাগর উদ্ধৃত উপরের শাস্ত্রবাণীটি মনযোগ দিয়ে লক্ষ করুন। এতে শুধু বিধবার জন্য দ্বিতীয় বিয়ের বিধান নয়; আরও বিভিন্ন কারণে নারীকে দ্বিতীয়বার বিয়ের নির্দেশনা আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী পরিত্যাগ করা যাবে তার নির্দেশনা বিভিন্ন শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে আজ যখন আমরা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নারীকে নিজের মতো বাঁচতে দেয়া বা পুনরায় বিয়ের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়নের পক্ষে কথা বলছি; এখনো একটি মহল শাস্ত্র মানতে রাজি নয়। তাদের সেই পুরাতন কথা, “হিন্দু বিয়ে জন্মজন্মান্তরের বন্ধন।” লক্ষণীয়, তাদের যুক্তি অনুযায়ী বন্ধনটা কিন্তু শুধুই নারীর জন্য। পুরুষের কোনো বন্ধন নেই – তারা চাইলে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে; এমন কি রক্ষিতাও রাখতে পারে। হিন্দু আইন তাদের বাধা দিচ্ছে না; এতে সমাজেও পুরুষের উপর কলঙ্ক আরোপ করছে না। কিন্তু নারীকে ঐ একজন পুরুষের কাছে বাঁধা হয়ে বাঁচতে হবে, তার পরিস্থিতি যতই প্রেমহীন ও প্রতিকুল হোক! এই হল জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন! এ থেকে মুক্তির জন্য বিদ্যাসাগরের পথ ধরে হাঁটতে হবে।
বিধবাবিবাহ’ গ্রন্থে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ!… অভ্যাসদোষে তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মপ্রবৃত্তি সকল এরূপ কলুষিত হইয়া গিয়াছে ও অভিভূত হইয়া রহিয়াছে যে, হতভাগা বিধবা-দিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্য রসের সঞ্চার হওয়া কঠিন এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত। তোমরা প্রাণতুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ; তাহারা দুর্নিবার-রিপু-বশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ; ধর্মলোপভয়ে জলাঞ্জলি দিয়া কেবল লোকলজ্জাভয়ে, তাহাদের ভ্রূণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য্য! শাস্ত্রের বিধি অবলম্বন পূর্ব্বক, তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্য যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ্ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহ।”
শুধু বিধবাবিবাহ আন্দোলন নয়; বাল্যবিবাহ এবং পুরুষদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও বিদ্যাসাগর ধারালো কলম চালিয়েছেন, প্রাণপণ লড়েছেন। অধ্যাপক শম্ভু চন্দ্র বাচস্পতির প্রিয়ভাজন ছাত্র ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বৃদ্ধবয়সে সেই বাচস্পতি মহাশয়ের আবার বিয়ে করার সাধ জাগলে তিনি তার প্রিয়তম ছাত্রের মতামত জানতে চান। বলাবাহুল্য ঈশ্বরচন্দ্র এতে প্রবল আপত্তি জানায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বাচস্পতি বাবু ঠিকই একদিন এক কন্যাতুল্য বালিকাকে বিয়ে করে আনলেন।
চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“বাচস্পতি মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের হাত ধরিয়া বলিলেন, “তোমার মাকে দেখিয়া যাও।” এই বলিয়া দাসীকে নববধূর অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিতে বলিলেন, তখন বাচস্পতি মহাশয়ের নববিবাহিতা পত্নীকে দেখিয়া ঈশ্বরচন্দ্র অশ্রুসংবরণ করিতে পারিলেন না। সেই জননীস্থানীয়া বালিকাকে দর্শন করিয়া ও সেই বালিকার পরিণাম চিন্তা করিয়া তিনি বালকের ন্যায় রোদন করিতে লাগিলেন। তখন বাচস্পতি মহাশয় “অকল্যাণ করিস্ না রে” বলিয়া তাঁহাকে লইয়া বাহির বাটীতে আসিলেন এবং নানাপ্রকার শাস্ত্রীয় উপদেশের দ্বারা ঈশ্বরচন্দ্রের মনের উত্তেজনা ও হৃদয়ের আবেগ রোধ করিতে ও তাঁহাকে প্রবোধ দিতে প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। পরিশেষে ঈশ্বরচন্দ্রকে কিঞ্চিৎ জল খাইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু পাষাণতুল্য কঠিন প্রতিজ্ঞাপরায়ণ ঈশ্বরচন্দ্র জলযোগ করিতে সম্পূর্ণরূপে অসম্মত হইয়া বলিলেন, “এ ভিটায়, আর কখনও জলস্পর্শ করিব না।”
মানুষের প্রতি হৃদয়বত্তা যতবেশি স্নেহকোমল; অন্যায়, অনাচার ও অপকর্মের বিরুদ্ধে হৃদয় ততবেশি কঠোর না হলে মহৎ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না।
পুরুষের বহুবিবাহ এবং মেয়েদের বাল্যবিবাহ সে সময়ে সমাজকে বিধবা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করেছিল। যার হৃদয় আছে, অনাচার নিবারণের দায় তার। তিনি যে দয়ার সাগর! ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবাবিবাহ আইনের জন্য আবেদন দাখিলের পর ঐ বছরই ২৭ ডিসেম্বর তিনি পুরুষদের বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আরেকটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। ইংরেজরা বিধবা বিবাহের অধিকার দিলেও বহুবিবাহ নিষিদ্ধের দাবিটি মানেনি। ১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার আবেদন করেন; কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশে নতুন করে হিন্দু আইন প্রণয়ন করা হয় এবং বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু আইন এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
যা হোক, বাল্যবিবাহ নিবারণে বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি সেদিন যা লিখে গেছেন, আজকের উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানও তাকে সমর্থন করছে। তিনি লিখেছেন,
“এইরূপে লোকাচার ও শাস্ত্র ব্যবহারপাশে বদ্ধ হইয়া দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা চিরকাল বাল্যবিবাহনিবন্ধন দ্বারা অশেষ ক্লেশ ও দুরপনেয় দুর্দশা ভোগ করিতেছি। বাল্যকালে বিধবা হওয়াতে বিবাহের সুমধুর ফল যে পরস্পর প্রণয়, তাহা দম্পতিরা কখন আস্বাদ করিতে পায় না; সুতরাং পরস্পরের সপ্রণয়ে সংসারযাত্রা নির্বাহকরণ বিষয়েও পদে পদে বিড়ম্বনা ঘটে, আর পরস্পরের অত্যন্ত অপ্রীতিকর সম্পর্কে যে সন্তানের উৎপত্তি হয়, তাহাও তদনুরূপ অপ্রশস্ত হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। ……সকল সুখের মূল যে শারীরিক স্বাস্থ্য, তাহাও বাল্যপরিণয় প্রযুক্ত ক্ষয় পায়। ফলতঃ অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অস্মদ্দেশীয় লোকেরা যে শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যে নিতান্ত দরিদ্র হইয়াছে, কারণ অন্বেষণ করিলে পরিশেষে বাল্যবিবাহই ইহার মুখ্য কারণ নির্ধারিত হইবেক সন্দেহ নাই।”
এখানে “লোকাচার ও শাস্ত্র ব্যবহারপাশে” শব্দগুচ্ছ লক্ষণীয়। বিদ্যাসাগর শাস্ত্রকে ‘পাশ’ বা বন্ধন হিসেবে সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। মানুষকে বুঝানোর জন্য এবং ভিন্নমত খন্ডনের জন্য তিনি যেমন শাস্ত্রের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন তেমনি আবার অগ্রহণযোগ্য শাস্ত্রবিধিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতেও কুন্ঠিত হননি। শাস্ত্রকারদের সমালোচনায় বলেছেন, “শাস্ত্রকারেরা এই বাল্যবিবাহ সংস্থাপনা নিমিত্ত এবং তারুণ্যাবস্থায় বিবাহ নিষেধার্থ স্ব স্ব বুদ্ধিকৌশলে কঠিনতর অধর্মভাগিতার বিভীষিকা দর্শাইয়াছেন।”
অবশেষে ১৯২৯ সালে ভারতে The Child Marriage Restraint Act (Act no XIX of 1929) পাশ হয়। এর ৩৮ বছর পূর্বে বিদ্যাসাগরের জীবনাবসান ঘটেছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১৯২৯ সালের The Child Marriage Restraint Act ‘রহিতপূর্বক সময়োপযোগী’ নতুন আইন পাশ করা হয়। ব্রিটিশ আইন পাশের ৮৮ বৎসর এবং স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বৎসর পর এই অগ্রগতি। আর বহুবিবাহ বন্ধের লড়াই এখন আমাদের ঘাড়ে।
১৮৫১ সালের ২২ জানুয়ারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। তার মধ্যে অন্যতম হল সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ সকল বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। সংস্কৃত কলেজে কেবল ব্রাহ্মণেরই প্রবেশ ছিল, শূদ্রদের সংস্কৃত পড়ার অধিকার ছিল না। সেখানে শূদ্রদের বিদ্যাশিক্ষার অধিকার দান বিদ্যাসাগরের এক অনবদ্য অবদান।
প্রসঙ্গটি বর্ণরোগের; বহু শাস্ত্রকারের বিধিতে এবং বর্ণবাদী রক্ষণশীল বৈশিষ্টে হিন্দু সমাজের অন্ত:জগত আজও রুগ্ন। এই জাত-গর্বীত অপকৃষ্টদের মাঝে একজন মানুষ বিদ্যাসাগর কেমন দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন?
১৮৬৭ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে বিদ্যাসাগর বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করে টানা ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো মানুষকে খাইয়েছেন। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার তার ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন,
“অন্নসত্রে ভোজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। অগ্রজ মহাশয় তাহা অবলোকন করিয়া দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, প্রত্যেককে দুই পলা করিয়া তৈল দেওয়া হইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহারা, পাছে মুচি, হাড়ী, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোক স্পর্শ করে, এই আশঙ্কায় তফাৎ হইতে তৈল দিত, ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য জাতীয় স্ত্রীলোকদের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন।”
বর্তমান সময়ের একটি ভাল লক্ষন হল, বর্ণবাদী ঘৃণার বিরুদ্ধে কথা বলা, এমনকি সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বর্ণবাদী অন্তর্নিহিত সত্য সরাসরি অস্বীকার করা লোকের অভাব নেই। আইন, শাস্ত্রবিধি ও বর্ণভেদ উল্লংঘন করে ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের বিয়ের ঘটনাও এখন অহরহ। আইনে না থাকলেও প্রয়োজনের তাগিদে হিন্দুরা একদিকে যেমন আইনবহির্ভুত পন্থায় বিবাহবিচ্ছেদের দলিল বানাচ্ছে এবং মেয়েদের অবৈধভাবে অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছে; অন্যদিকে তেমনি হিন্দু আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনের জোয়ার-ভাটার টানে পড়ে মাঝে মাঝে অসবর্ণ বিবাহ দিচ্ছে। এই বিবাহগুলো আইনত অবৈধ। অবৈধ বিয়ের সন্তান বৈধ হয় না। অবৈধ সন্তানের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার বৈধ সন্তানের মতো হয় না। তাই অসবর্ণ বিয়েকে বৈধতা দেওয়ার জন্যেও হিন্দু আইন সংস্কার করা দরকার। অথচ নতুন যুগের অপকৃষ্টরা বলছে, তারা নাকি হিন্দু আইনের দাড়ি, কমা, সেমিকোলন কিছুই বদলাতে দেবে না!
এখানে সংস্কারবিরোধীদের স্ববিরোধের একটি উদাহরণ দেই। বিধান মানলে শূদ্রের শাস্ত্র আলোচনা, বিশেষত বেদপাঠ, চলে না। পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের ৬৪ নম্বর শ্লোকটি হল,
কপিলাক্ষীরপানেন ব্রাহ্মণীগমনেন চ।
বেদাক্ষরবিচারেণ শূদ্রস্য নরকং ধ্রুবম্।।
অর্থ: “কপিলা গাভীর দুগ্ধ পান, ব্রাহ্মণীগমন এবং বেদাক্ষর বিচার –এই কার্য্যে শূদ্র নিশ্চয়ই নরকগামী হইবে।”
কপিলা সবচেয়ে উন্নত জাতের গাভী। শূদ্রের জন্য শুধুমাত্র ব্রাহ্মণী ও শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ নয়, তাদেরকে গাভীর দুধ পান করতেও নিষেধ করা হয়েছে। এই বিধানটি আজকের দিনে আর কেউ মানতে রাজি নন এবং মানা সঙ্গতও নয়। এসব অন্যায় বিধান মানতে গেলে ৯৯ পার্সেন্ট শূদ্র অধ্যুষিত এই দেশে হাতে গোনা কয়েকজন ব্রাহ্মণ ছাড়া হিন্দু বিলীন হয়ে যাবে। গণমানুষকে শাস্ত্র থেকেই সরিয়ে দিলে সে জাতির অপমৃত্যু অনিবার্য। যা হোক, এবার আরেকটি শাস্ত্রবাণী শোনাই – যাকে আমরা ধর্ম ও স্বর্গপ্রদ উপদেশ হিসেবে মানতে আপত্তি করিনা। কারণ উপদেশটা নারীর জন্য।
তীর্থস্নানার্থিনী নারী পতিপাদোদকং পিবেৎ।
শঙ্করস্ব্যাপিবিষ্ণো্র্ব্বা প্রয়াতি পরমং পদম।।
শ্লোক ১৩৭, অত্রি সংহিতা
অর্থ: “নারী তীর্থস্নান-অভিলাষিণী হইলে স্বামী, শিব বা বিষ্ণুর পাদোদক পান করিবে; ইহাতে পরম স্থান লাভ করিবে।”
এখানে তীর্থ করার পরিবর্তে নারীকে স্বামীর পা ধোয়া জল পান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। স্বামীকে শিব এবং বিষ্ণুর সমতুল্য করে দেখানো হয়েছে। এটাকে নারীর পতিপরায়নতা ও ধর্ম হিসেবে ভাবতে আমাদের ভালই লাগে! স্বামীর সেবা করা নারীর ধর্ম এবং এ ধর্ম উত্তম – এ কথা কয় পার্সেন্ট লোক অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন না? এই বিধানের মধ্যে পুরুষের সুবিধা এবং স্বার্থ নিহিত আছে কিনা? নারীকে পুরুষের দাসী হিসেবে দেখা হচ্ছে কিনা? সে কারণেই নারীর সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে না, তারা পুরুষের অধিনস্ত ও পুরুষ দ্বারা পালিত হবে – এ ধরণের মনোভঙ্গি থেকেই নারীর সমঅধিকারের বিরোধিতা হচ্ছে কিনা?
দাদারা, শাস্ত্র যখন আপনাকে ব্রাহ্মণের পা ধোয়া জল খাওয়ার পরামর্শ দেয়, সেই পরামর্শ ভাল লাগে না। কিন্তু শাস্ত্র যখন আপনার স্ত্রীকে স্বামীর পা ধোয়া জল খেতে পরামর্শ দেয় সেটা আপনার ভাল লাগে! এ মনোবৃত্তিকে আমাদের স্ববিরোধী চরিত্র বলবেন কিনা? বন্ধু, আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি ভন্ড ও কপট হবেন, নাকি অন্তরে বাইরে সত্যিকারের মানুষ হবেন। যারা বর্ণবৈষম্য বিলোপ চায়, কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য বহাল রাখতে চায় তাদের কি বলবেন? বর্ণবৈষম্য খারাপ, তবে লিঙ্গবৈষম্য কি ভাল? নিজের শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি চান, কিন্তু নারীকে মুক্তি দেবেন না!
বর্ণবৈষম্যের দরকষাকষি সবচেয়ে বেশি হয় বিয়ের সময়। এ বড় জটিল অহংবোধ, যা মানুষকে মানুষের মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করে। ইংরেজরা ১৯৪৬ সালে The Hindu Marriage Disabilities Removal Act, 1946 শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করে গেছে। এই আইনেও ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের বিয়েকে বৈধ করা হয়নি। শুধু একই বর্ণ ও গোত্রের মধ্যে যেসকল উপবিভাগ রয়েছে তার মধ্যে বিয়েকে বৈধ করা হয়েছে। এটাও হয়েছে বিদ্যাসাগরের বর্ণবাদ বিরোধী সংস্কারের প্রায় ৮০ বছর পরে; ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেওয়ার মাত্র এক বছর আগে।
উত্তরপ্রজন্ম বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে সমান তালে চলতে পারেনি; অনেক দেরী হয়েছে, সমাজ উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। তবে ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রথম দশকেই হিন্দু আইন নতুন করে প্রণয়ন করেছে; সময়ের ধারাবাহিকতায় লিঙ্গবৈষম্য নিরসন করেছে। কিন্তু অচলায়তনের গহ্বরে আটকে গেছে পাকিস্তানের খপ্পরে পড়া বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও বিভিন্ন জনজাতি। আইয়ুব সরকার The Muslim Family Laws Ordinance, 1961 জারির মাধ্যমে এদেশের মুসলিম আইনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও অগ্রগতি সাধন করলেও ইংরেজ চলে যাওয়ার পর থেকে আজ অবধি হিন্দু আইন সংশোধন হয়নি। এই আইনের আওতাভুক্ত সকল নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী নিদারুণ বৈষম্যের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছ।
শুধু নারী হয়ে জন্মানোর কারণে কেউ পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে – আধুনিক পৃথিবীতে এরকম বাস্তবতা এক অবিশ্বাস্য সত্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি এরকম বৈষম্য করবে না বলে সংবিধানে অঙ্গিকার করেছে। অথচ হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীরা পিতার সম্পত্তির ভাগ পাওয়া জন্য আদালতের স্মরণ নিলে তাদের হিন্দু আইন দেখিয়ে বিদায় করা হয়। রাষ্ট্র হিন্দু আইন মানছে; সংবিধান মানছে কিনা প্রশ্ন!
রামমোহন হয়ে বিদ্যাসাগরের পথ ধরে ইংরেজদের ২০০ বছরের শাসনের শেষ দিকে বেশ কিছু কোডিফাইড হিন্দু আইন হয়েছে এবং পুরাতন প্রথার পরিবর্তন হয়েছে। কিছুক্ষেত্রে নারী ও প্রতিবন্ধীদের সীমীত অধিকার দেয়া হয়ে্ছে; তা নিতান্তই সীমীত। The Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act, 1928 অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ও দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পত্তিতে অধিকার প্রদানের কড়াকড়ি ব্যবস্থা কিছুটা প্রশমিত করা হয়। কিন্তু তা বাংলার দায়ভাগ আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হওয়ায় এদেশে প্রতিবন্ধী ও কুষ্ঠরোগীরা এখনো সম্পত্তির অধিকার পায় না। The Hindu Women’s Rights to Property Act, 1937 এবং The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946 ভারতীয় নারীদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের করুণার ফল নাকি বিদ্যাসাগরদের সেযুগের আন্দোলনের বিলম্বিত ধারা সে বিতর্কে যেতে চাই না। তবে বিদ্যাসাগরের পথ ধরে চলতে পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ। বাঙালি নেতৃত্ব সে পথে থাকলে হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবি তোলার কারণে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যকে লাঞ্চিত হতে হতো না। আজ যখন শিক্ষায় ও কর্মজীবনে বিপুল নারীর সমাবেশ তখনও হিন্দু নারীদের অধিকারের কথা বললে অশ্লীল গালাগাল, হুমকী, কুৎসা, অপপ্রচার ও ঝাড়ু মিছিলের সংগঠক পাওয়া যায়। এ অবস্থা থেকে সমাজকে ফেরাতে হবে। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে দায়িত্ব নিতে হবে। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।“
আসলে মানুষের সমর্থন নিয়ে উদ্বেগ নেই। বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগরের আবেদনে সহ-স্বাক্ষর করেছিলেন মোটে ৯৮৭ জন ব্যক্তি। আর এ আবেদনের বিরোধিতাকারী পাল্টা আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রায় ৩৬০০০ ব্যক্তি। আইনটি পাস হওয়ার ২০০ বছর পরে আজ আমরা দেখছি, বিধবা বিবাহের অধিকার দেয়া অন্যায় হয়েছিল – এরকম কথা কেউ বলছে না। আর সতীদাহ সম্পর্কে কি বলব? সতীদাহ বলতে অতীতে আদৌ কিছু ছিল, আমাদের দাদারা তা এখন পুরোপুরি অস্বীকার করতে চান। আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করি হিন্দু আইনের আওতাধীন নারীদের সমঅধিকারের জন্য আমরা যেসব সংস্কার দাবি করছি তা শতভাগ বাস্তবায়িত হবে। জনগণ তা সার্বিকভাবে গ্রহণ করবে এবং উপকার পাবে। তারপর একদিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বিশ্বাস করতে চাইবে না। তারা অবাক হয়ে ভাববে, এমনও একটি সময় ছিল যখন নারী হয়ে জন্মানোর কারণে সমাজের অর্ধেক মানুষের পিতার সম্পত্তি লাভের অধিকার ছিল না। তারা ভেবে আরও আশ্চর্য হবে, তাদের পূর্বপুরুষদের অনেকে কাঙ্খিত পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছিল! আমরা ভবিষ্যতের বিষ্ময় হব; আমরা বিদ্যাসাগরের পথ ধরে হাঁটব। মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের ২০৩তম জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
———
সাধারণ সম্পাদক
জাতীয় প্রেস ক্লাব ও