পুলক ঘটক
“নারী পুরুষ কি সমান?” যদি সমান না হয় তাহলে সমান অধিকার দেওয়া যাবে না, তাই না? যদি কেউ দুর্বল হয়, তবে তাকে বঞ্চিত করা বৈধ তাই না? যদি কেউ অসহায় হয় তবে তার উপর অন্যায় করা ঠিক আছে, তাই না?
এই জংলি চিন্তাধারা পৃথিবীতে সকল প্রকার বৈষম্য ও অন্যায় পরিকল্পনার অন্তর্নিহিত মনস্তত্ব। হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞেরও অন্তনির্হিত দর্শন ছিল, ইহুদিরা জার্মান আর্যদের সমান নয়। শোষণমূলক অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ধারণায় সমাজতন্ত্রের যে বিরোধিতা, তারও মূলমন্ত্র হল, সব মানুষ সমান নয় – তাই বৈষম্য করা ঠিক আছে। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর অধিকার হরণ ও দমনের আদর্শিক ভিত্তিও হল সবাই সমান নয়, তাই বৈষম্য জায়েজ।
এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ বিশালদেহী; কিছু মানুষ খর্বাকৃতি, কেউ সাদা, কেউ কালো কেউ তামাটে বর্ণের। কারও গায়ের জোর এবং মস্তিস্কের জোর বেশি। এই কারণে এক শ্রেণীর মানুষ আরেক শ্রেণীর মানুষের উপর বৈষম্য ও জুলুম করা জায়েজ কিনা?
প্রশ্ন করেছেন, “নারী পুরুষ কি সমান?” উত্তর দেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করতে চাই, সব পুরুষ কি সমান? তাহলে সব পুরুষের কি সমান অধিকার থাকা উচিত? একজন ব্যক্তির পাঁচ ছেলের মধ্যে সবাই কি সমান? তাহলে পাঁচ ছেলের সমান অধিকার হয় কি করে?
হিন্দু আইনে কুষ্ঠ রোগীর সম্পত্তিতে অধিকার নেই। অঙ্গহীন ব্যক্তির (পুরুষ হলেও) সম্পত্তিতে অধিকার নেই। এরও অন্তর্নিহিত যুক্তি হল, সব মানুষ সমান নয়। বলুন দেখি, একজন মানুষ যৌন সামর্থ্যহীন হলে সে কি আপনার সমান থাকে? সে পুত্র সন্তান জন্মদিতে পারে না। তাই যৌনসক্ষমতাহীন লোকদের সম্পত্তিতে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে হিন্দু আইনে। এটা ঠিক হয়েছে কিনা? এই কারণে হিজড়াদেরও পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার নেই!
একজন লোকের জন্ম থেকে একটি পা বাঁকা; স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে চলতে পারে না, লোকটার অনেক কষ্ট – এ কারণে তার পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার হরণ করা হয়েছে। হিন্দু আইনের এই বিধান ঠিক আছে কিনা? কারণ একজন পঙ্গু তো আপনার সমান বা সমকক্ষ নয়। তাই সে কেন আপনার-আমার মতোই সম্পত্তির অধিকারী হবে? তার সম্পত্তি থাকা ঠিক হয় কিভাবে, তাই না?
হিন্দু আইনে এমনই বৈষম্যের নির্দেশ আছে শ্রবণপ্রতিবন্ধী, বাকপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা অন্য যে কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীর প্রতি। জিনিসটা ভাল না? কারণ মানুষ তো সমান নয়!
যা হোক, আমাদের দেশের সংবিধান কিন্তু বলছে অন্য কথা। যে মানুষ কোনো কারণে প্রতিবন্ধকতায় আছে, দুর্বলতায় আছে, পিছিয়ে আছে – তার ক্ষেত্রে শুধু সমান অধিকার নয়, তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; বাড়তি অধিকার দিতে হবে, বিশেষ অধিকার দিতে হবে। তাই নারীকে শুধু সমান অধিকার দিতে হবে – এতটুকু নয়; নারীদের এগিয়ে আনার এবং সমাজে সমপ্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনে বিশেষ অধিকার বা বাড়তি অধিকার দিতে হবে।
সংবিধান অনুযায়ী সমাজের কোনো কোনো অংশের জন্য কোটা সংরক্ষণের আইন করা হয়। যে কোনো প্রকার দুর্বলের প্রতি সংবিধানের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের এরকম ধারণা কি পক্ষপাতমূলক হল না? বরং যে দুর্বল, যে আমার সমকক্ষ নয়, তাকে দমিয়ে রাখতে হবে, তারটা কেড়ে খেতে হবে – এটাই তো হওয়া উচিত? কি বলেন বিবেকবান দাদা?
এবার আসুন, নারী-পুরুষ সমান নাকি অসমান সে বিষয়ে একটু ভাবি। পুরুষের গায়ের জোর স্বাভাবিক বৈশিষ্টে নারীর চেয়ে বেশি। তাই নারী পুরুষের সমান নয় এবং নারীর অধিকার হরণ করা যথার্থ। নারীর ধৈর্য ও সহনশীলতা পুরুষের চেয়ে বেশি। তাই নারীকে ঠকানো উচিত।
নারী মা হতে পারে, পুরুষ পারে না; তাই নারী নিচু জাতের; তার প্রতি বৈষম্য করা যাবে। আরও বৈষম্যের কারণ আছে। নারী দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করতে পারে না, পুরুষ দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করতে পারে – এজন্য বৈষম্য করতে হবে। নারী বুক না ঢেকে ঘুরতে পারে না, পুরুষ জামা গায়ে না দিয়েও ঘুরতে পারে – ইত্যাদি যুক্তিতে হিন্দু তালেবান এবং মুসলমান তালেবান উভয়ে ভায়রা-ভাই। এরকম নারী-পুরুষ অসাম্যের আরও কত যুক্তি নেবেন?
দাদা, নারীর চাইতে আপনার গায়ের জোর বেশি একথা যেমন ঠিক; তেমনি আপনার চেয়ে একটা বলদের শক্তি আরও বেশি, একথাও ঠিক। তাহলে বলদ তো আপনার চাইতে উন্নত জাতের প্রাণী! তার অধিকার আপনার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত! কি বলেন?
তেমনি ভাবে মহিষ, ঘোড়া, হাতি ইত্যাদি প্রাণীর শক্তি আরও বেশি। আরেকটি দিক আছে। হাতির শক্তি বেশি হলেও মানুষ হাতির পিঠে চড়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াতে পারে। তাই কে শক্তিমান বোঝার জ্ঞানটাও দোপায়া বলদদের বুদ্ধিতে এক রকম, মানুষের বুদ্ধিতে আরেক রকম দেখা যায়। একারণেই দেখতে পাই একজন পুরুষ কখনো কখনো বলদের মস্তিস্কে মন্তব্য করে; অথচ, কথিত দুর্বল এক নারী সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পায়!
শক্তির মূল বিষয়টি মানব মস্তিস্কে নিহিত। সেখানে নারী পুরুষের চেয়ে কম – এ কথা কিভাবে প্রমাণ করব? যে হিন্দু মেয়েটা জজ বা মেজিস্ট্রেট হয়েছে, বলদীয় মন্তব্যকারী একজন পুরুষ কি তার সমান হতে পারে? কে বেশি শক্তিশালী? তাহলে বলদা মার্কা পুরুষের অধিকার এবং ঐ নারীর অধিকার সমান হয় কিভাবে? কি বলবেন?
যে নারী বিজ্ঞানী হয়েছে, সেনাবাহিনীতে, পুলিশে বা সিভিল সার্ভিসে বড় কর্মকর্তা হয়েছে অথবা রাজনৈতিক নেতা হয়েছে, যে নারী ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক বিত্তশালী হয়েছে – আপনি কি তার সমান অবস্থানে আছেন? নাকি আপনার মতো দশ-বিশজন পুরুষ তার অধিনস্ত? তাহলে অধিকারের ধরন কেমন হওয়া উচিত? শক্তিমানের বেশি অধিকার?