বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন না থাকায় প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে মানুষ অবৈধ উপায় বেছে নিচ্ছে।
পুলক ঘটক
মহাভারতে দ্রৌপদি একসঙ্গে পাঁচ স্বামীর সঙ্গে সংসার করেছিলেন। এ ঘটনা সেযুগেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছিল প্রায় বিরল ঘটনার একটি। মাতৃতান্ত্রিক কিছু সমাজে নারীর একাধিক পতি থাকার প্রচলন এখনো রয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে এই বিরল ব্যাপারটি এখনো ঘটছে এবং নিরবে বেড়ে চলেছে। নারীরা একই সঙ্গে দুই পুরুষের সঙ্গে ঘর না করলেও ইদানিং এক স্বামী থাকতে আরেকজনকে বিয়ে করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এক নারীর একাধিক স্বামী বর্তমান থাকছে। বিদ্যমান হিন্দু আইনে ডিভোর্সের সুযোগ না থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে এরকমটি করছে। যেখানে সংসারে সুখ নেই, চরম অশান্তি সেক্ষেত্রে অনেক নারী বাধ্য হয়ে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকছেন। অনেকক্ষেত্রে তারা একাকি সারাজীবন নিঃসঙ্গতায় পার করছেন; কেউ কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করছেন; স্বামী বর্তমান থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে!
সনাতন ধর্মশাস্ত্রে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নারীর পুনরায় বিয়ে দেওয়ার বিধান থাকলেও স্বাভাবিক নিয়মে নারীর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের বৈধতা নেই। শুধু ধর্ম নয়, বিদ্যমান হিন্দু আইনেও নারীর দ্বিতীয় পতি গ্রহণের বৈধতা নেই। অথচ এই অবৈধকাজ করতে হিন্দুরা আপত্তি করছে না। কিছু লোক আছে, যারা এরকম অধর্মীয় ও অবৈধকাজ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ক্যাম্পেইনও করছে। তারা ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ভারতের মতো বাংলাদেশে হিন্দুু বিবাহবিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করতে বাধা দিচ্ছে। আইনগত বৈধভাবে ডিভোর্স প্রদান করে হিন্দু নারীকে দ্বিতীয় বিয়ের বৈধ সুযোগ দিতে আপত্তি করছে; আর অবৈধভাবে এসব চালানো সমর্থন করছে।
উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসনের শেষ সময়ে ১৯৪৬ সালে প্রণীত Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act বাংলাদেশে এখনো চালু আছে। ঐ আইন অনুযায়ী সংসারে প্রবল অশান্তির ক্ষেত্রে একজন হিন্দু বা বৌদ্ধ নারী আদালতের মাধ্যমে স্বতন্ত্র বসবাসের অনুমতি পায়। কিন্তু তাতে তার স্বামী প্রাক্তন হয়ে যায় না; বরং আলাদা থাকলেও স্বামীর কাছ থেকে সে ভরণপোষণ পায়। এ অবস্থায় স্বামী যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করলেও বাধা নেই; কিন্তু সেপারেট হলেও ঐ নারীর দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সুযোগ নেই। কারণ তার স্বামী আছে। তবে ইদানিং অনেকে এই আইনও মানছে না। আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ না থাকলেও তারা বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের চুক্তি করছে; যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ধরনের চুক্তিপত্রের কোন আইনগত ভিত্তি নেই, একদম ভূয়া।
বিদ্যমান হিন্দু আইনে চুক্তি করলেই স্বামী সাবেক হয়ে যায় না; বর্তমান থাকে। ধর্মীয় ও আইনগতভাবে একজন নারীর স্বামী বর্তমান থাকতে তাকে বিয়ে করা বা বিয়ে দেয়ার কাজ অসভ্যতার নামান্তর। যারা এই অবস্থার পরিবর্তনে বাধা দিচ্ছে, তারা সভ্যতার প্রতিবন্ধক এবং অসভ্যতার ধারক। স্বামীর কাছ থেকে সেপারেট থাকা নারীকে বিয়ে করে তার দ্বিতীয় স্বামী হবেন? আপনার মেয়ে নির্যাতিত ও বিপন্ন হলে তাকে স্বামী থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে কিভাবে দেন? যদি দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চান তবে অবশ্যই ডিভোর্স আইন দরকার। শাস্ত্রে বিধান থাকা সত্ত্বেও যারা হিন্দু ডিভোর্স আইন প্রণয়ণে বাধা দিচ্ছে তারা সমাজের শত্রু।
[লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।]