রাজনীতি যদি বিভাজনের হয়, লড়াইটা যদি সংখ্যালঘুর একার হয়….

এই মিছিল বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা গ্রামে রুপালী দাস নামে এক গৃহবধুর বিরুদ্ধে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর রুপালীকে ধর্ম অবমাননার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৌহিদি জনতার এই সফল তৎপরতার খবর বাংলাদেশের মিডিয়া গোপন করেছে। অপরিচিত কিছু অনলাইনে “ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল” করার সংবাদটি দিয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে আজ বাগেরহাট জেলা পু্লিশ সুপার আবুল হাসনাত খান এবং রামপাল থানার ওসি আশরাফুল আলমের সাথে আমি কথা বলেছি। যতদূর বুঝলাম, মহিলাকে গ্রেপ্তার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকাতে পারায় প্রশাসন সন্তোষ্ট ও গর্বিত।
ওসি আমাকে বলেছেন, “সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কাছাকাছি গিয়েছিল।” তিনি জানিয়েছেন, ২৪ তারিখের ঘটনা, ২৬ তারিখ মামলা হয়েছে এবং রুপালীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৭ তারিখ সেখানে পুলিশের উদ্যোগে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে স্থানীয় গণপ্রতিনিধি, মওলানাবৃন্দ এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দসহ বহু মানুষ ছিলেন। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।
২৪ তারিখ কি ঘটেছিল? রুপালী সকাল ৮ টায় গৌরম্ভা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে ডিপ টিউব ওয়েল থেকে পানি নিতে গেলে সেখানে মোমিনা বেগম নামে এক মহিলার সাথে ঝগড়া বাধে। ঝগড়ায় মোমিনা হিন্দুদের ধর্ম নিয়ে কি কি প্রশংসাসূচক বাক্য বলেছেন তা অবিবেচ্য। এর প্রতিবাদ করার হিম্মত দেখানো হিন্দুদের অন্যায়। কিন্তু মোমিনার অভিযোগ, রুপালী নাকি ঝগড়ার সময় ইসলাম ধর্মের নবীকে নিয়ে কটুক্তি করেছেন; যা আমলযোগ্য। এ নিয়ে ২৫ তারিখ সালিশ বসে, রুপালী অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু মুরুব্বিদের নির্দেশে তাঁকে মোমিনার কাছে পা ধরে মাপ চাইতে হয়। ধরে নেওয়া হয়েছিল, বিষয়টি মিমাংশা হয়েছে। কিন্তু পরদিন গায়েবী তৎপরতায় উত্তেজনা বেড়ে যায়। তৌহিদি জনতা মিছিলসহকারে রুপালী দাসের বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ ঐ গৃহবধুকে আটক করে পরিস্থিতি ঠান্ডা করে। পরে ইয়াসিন খন্দকার নামে এক ব্যক্তির মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
রুপালী যেহেতু ফেসবুকে কোনোকিছু লেখেননি এবং কোনোপ্রকার ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ধর্ম সম্পর্কে উচ্চবাচ্চ করেননি, তেমন কোনো প্রমাণও নেই – তাই তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। মামলা হয়েছে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯৮, ১৫৩ এবং ৫০৬ ধারায়। ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কোন বাক্য বা শব্দ বিকৃত বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা হলে তা ২৯৮ ধারার আওতায় পরে। এই অপরাধ প্রমাণিত হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। তবে আমার জানামতে এই অভিযোগে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। তদন্তের পর আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তারপর গ্রেপ্তার করা যায়। আর দন্ডবিধির ১৫৩ ধারার অভিযোগ হল, “জেনে বুঝে এমন কোনও কিছুতে উস্কানি দেওয়া, যাতে হিংসা ছড়াতে পারে।” এই জেনে বুঝে উস্কানি দেওয়ার কাজটি সেখানে কারা বা কোন পক্ষ করেছে তা বিবেচ্য। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রাস্ট্র ব্যবস্থা নেবে, নাকি উল্টো রুপালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে উস্কানিদাতাদের শান্ত করবে? এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কোন দিকে যাবে – সময় থাকতে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে। দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার অভিযোগ হল, “অপরাধমূলক হুমকি” প্রদান। এই “অপরাধমূলক হুমকী” প্রদানের সাহস এবং সামর্থ্য রুপালীদের কতটুকু আছে, এই অপরাধটি সেখানে কারা করেছে এবং করে যাচ্ছে তা সহজবোধ্য। রাস্ট্র এবং সমাজ যদি ইচ্ছে করেই বুঝতে না চায়, তবে ইউটিউবে এবং ফেসবুকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কন্টেন্ট তাদের সামনে খুলে দেখালেও তারা দেখবে না, বুঝবে না। দেশটা শেষ পরিণতির দিকে গেলে একদিন কোন রাষ্ট্রকে কারা বন্ধু হিসেবে পছন্দ করবেন? এখন যেমন রাজনীতিতে কে কাকে বন্ধু হিসেবে পছন্দ করছে তার ভালমন্দ মূল্যায়নের প্রয়োজন এবং নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ কারও নেই! শুধু নিজের সুবিধার জন্য উপস্থিত মিত্র দরকার!
বাংলাদেশে এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে এর বিরুদ্ধে হিন্দুদের সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ করার শক্তি ও সামর্থ্য কতটুকু আছে? মেয়েরা যখন সমঅধিকার চায় তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল মহল যতটা সোচ্চার – সংখ্যালঘুদের উপর আইনি-বেআইনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে কি ততটা সরব? ওসি আমাকে বলেছেন, রুপালীকে গ্রেপ্তারের পর “শান্তি ও সম্প্রীতি” সমাবেশে বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা সেখানে থেকে কি অর্জন করেছেন? প্রশাসনের এবং সেখানকার সুশীল সমাজের লোকজনও উপস্থিত ছিলেন। তারা কি সবাই “তৌহিদি জনতার” দাবির সঙ্গে একমত হয়ে ফিরেছেন? রুপালী এখনো জেলে কেন? এই মামলা তো জামিনযোগ্য। সাম্প্রদায়িক উস্কানির মিছিলে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
আরেকটি দিক বিবেচ্য। তা হল, বিষয়টিকে হিন্দু বনাম মুসলমানের লড়াই হিসেবে দেখবেন কিনা? এগুলোকে কতদূর নিয়ে যাবেন? তাতে কারা জয়ী হবে, কার উপকার হবে? আমি বাংলাদেশের বহু জায়গায় ঘুরেছি। অনেক জায়গায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাম এখনো আছে। আবার এমনও গ্রাম আছে, যেখানে একটি মাত্র হিন্দু পরিবার। ঐ একটি হিন্দু বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে যদি কেউ তার ধর্ম নিয়ে যাচ্ছেতাই বলে, তবে তার পক্ষে মিছিল করবে কে? হিন্দুরা? তারা বাড়িসুদ্ধ মোটে ৭ জন লোক? অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি মানুষ না দাঁড়ায়, যদি হিন্দু-মুসলমান বিভেদ করে, তবে অন্যায়কে প্রতিহত করা যায় না। সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ যদি সংখ্যালঘুর একার লড়াই হয়, তবে বাংলাদেশ হেরে যাবে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি জয়ী হবে। কিন্তু আফসোস হল, আমরা যখন জীবনভর অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার জন্য লড়ছি তখন এখানেই নয়া হিন্দুত্ববাদী কতিপয় গ্রুপ ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এই হিন্দুত্ববাদীরা ধর্ম নিরপেক্ষতার বিরোধিতা করছে, সেক্যুলার রাজনীতিক ও সমাজ নেতাদের বিরোধিতা করছে, জামায়তে ইসলামী ও তার নেতাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে এবং হিন্দু-মুসলিম মিলিত শক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক; জয় মানুষ।
[লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ