পুলক ঘটক
পুরুষরা সবাই মানুষ, কিন্তু নারীরা মানুষ নয়; নারীরা সবাই দেবী – এই কথাটি ভন্ডামির সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। এই কথা বলেই নারীর প্রতি সকল প্রকার বঞ্চনা চাপানো হয়; মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকার অস্বীকার করা হয়। আসলে একজন হিন্দুও নারীকে দেবী হিসেবে দেখেনা; দেখা বাস্তবসম্মত নয়। সবাই নারীকে মানুষ হিসেবেই জানে, রক্তমাংসের মানুষ, দোষে গুণে মেশানো মানুষ –এটাই বাস্তব। কিন্তু অধিকার হরণের জন্য এবং পুরুষের অধিনস্ত রাখার জন্য নারীকে নানারকম মিথ্যা উপাধি দেওয়া হয়। যে মতলববাজ নারীকে দেবী বলছে, সে কিন্তু তার স্ত্রীকে সকাল-বিকাল দেবী হিসেবে প্রণাম করে না, বরং স্ত্রীর কাছেই সেবা চায়।
জগন্মাতার সর্বব্যাপিত্ত্বের যে মতবাদ সনাতন ধর্মে আছে তা কোনো ঈশ্বরদ্রষ্টা মহাপুরুষ চাক্ষুষ দেখে থাকতে পারেন। সাধারণ মানুষ তা দেখে না। তাছাড়া শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, সৃষ্টি জগতের সবকিছুতেই নারী বা স্ত্রীলিঙ্গকে মহামায়া’র বহুরূপ হিসেবে সনাতন ধর্মে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ কি পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, কুকুরী, বাঘিনী, সিংহী সবকিছুতেই ঈশ্বরের মাতৃরূপ দর্শন করে? সকল প্রাণীর স্ত্রীজাতিকে কি দেবী হিসেবে দেখে? কেউ দেখে না। পরাতত্ত্বকে সংসার জীবনে টেনে এনে নারীর উপর বৈষম্য চাপানো অন্যায় অপকৌশল। তাছাড়া, ঈশ্বর সর্বব্যাপী – এই ধারণায় শুধু নারীরাই ঈশ্বরী নন, পুরুষও সেক্ষেত্রে ঈশ্বর। যত নারী সব দেবী হলে, যত পুরুষ সব দেবতা। তাহলে জগতে কোনো মানুষ নেই, সবাই শুধু দেবী আর দেবতা।
বন্ধুরা,
আধ্যাত্ম সাধনায় যদি মানুষের মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের চেষ্টা কেউ করতে চান, করতে পারেন। সনাতন ধর্মে তাতে বাধা নেই। চাইলে একটি উইয়ের ঢিপিতেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা করে সাধনা করতে পারেন। একটি তেলাপোকার মধ্যেও ঈশ্বর আরাধনা করতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ আপনি নিজে নিছক মানবীয় চিন্তার মানুষ, অপর মানুষকেও মানুষ হিসেবে স্বীকার করুন। মানুষকে মানবমর্যাদা দিন; মানুষের অধিকার দিন।
আর সত্যই যদি আপনি নারীকে দেবী হিসেবে দেখেন, তবে নারীর পায়ে আত্মসমর্পণ করুন। নারীকে সর্বশক্তির আধার হিসেবে স্বীকার করুন। যাকে ‘দেবী’ উপাধি দিচ্ছেন তাকেই আবার ‘অবলা’ উপাধি দিয়ে তার অধিকার হরণ করবেন না। তাকে আপনার রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে মানুন। দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, রক্ষাকালী, মহাকালীকে আসলে কি রূপে দেখেন, সত্য বলুন। মুখে একটা অন্তরে আরেকটা, স্ববিরোধী, প্রতারক ও ভন্ড হওয়া ধর্মের কাজ হতে পারেনা। কখনো সতী বানিয়ে পুড়িয়ে মারবেন, কখনো আবার দেবী বানীয়ে তার মানবিক অধিকার হরণ করবেন –এ অন্যায় বন্ধ করা জরুরী।
নারীতে জগন্মাতার অস্তিত্ব দর্শন আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সত্য, কল্পনায় সত্য, কাব্যে সত্য, ভাবের রাজ্যে সত্য এবং আরও নানা অর্থে সত্য হতে পারে –যে সত্য মানুষ সচারচর দেখে না। সত্য এবং অন্তর্নিহিত সত্যের জয় হোক। জয় মা। জয় মানুষ।