আদিবাসী সার্টিফিকেট দিতে গড়িমসি কেন?

মিথুশিলাক মুরমু

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার সুরমা চা বাগান থেকে একজন আদিবাসী সার্টিফিকেটপ্রত্যাশী এসএমএস করে জানান, ‘আমাদের এদিকে সাঁওতাল টাইটেল লিখলেও সাঁওতাল বলে গণ্য করা হচ্ছে না। এজন্য অনেক ছাত্রছাত্রী আদিবাসী হিসেবে প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্য কী করতে হবে আমাদের পরামর্শ দিলে ভালো হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনমান উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচি’র আওতায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি পেতে হলে ডিসির দেয়া সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। আর ডিসি কর্তৃক ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র প্রত্যায়নপত্র প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে টিএনওর সার্টিফিকেট জমাদান। আর টিএনওর প্রাপ্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও কার্যত আদিবাসী সংগঠন থেকে আদিবাসী হিসেবে একটি প্রত্যায়নপত্র সংযোজন করা হয়ে থাকে। বিষয়টি নিয়ে উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য এমন এক সাঁওতাল ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়। ঘটনার আদ্যেপান্ত অবহিত হয়ে কিছু বিষয় বোঝা গেল।

প্রথমত, আদিবাসী সাঁওতালদের ১২টি টাইটেল (মুরমু, সরেন, হেমব্রম, হাঁসদা, টুডু, বাস্কে, বেসরা, বেদেয়া, পাউরিয়া, চঁড়ে, কিস্কু ও মারডি) রয়েছে। সাঁওতালরা নামে শেষে পদবি হিসেবে উপরিউক্ত ১২টির যে কোনো একটি ব্যবহার করে থাকে। ১৯ মার্চ ২০১৯ মার্চের প্রজ্ঞাপন ও ২৩ মার্চ প্রকাশিত গেজেটে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ হিসেবে ২৩ নম্বর সিরিয়ালে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। অপরদিকে আদিবাসী উরাঁওদের সিরিয়াল নম্বর হচ্ছে ১ নম্বরে।

আদিবাসী সাঁওতালরা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিশ্বের আরো অন্যান্য দেশে বসবাস করেন। উক্ত দেশগুলোর কোথাও আদিবাসী সাঁওতালরা নামের পদবি হিসেবে ‘সাঁওতাল’ শব্দটি ব্যবহার করে না। তবে এটির ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশের সিলেট ও খাগড়াছড়ি জেলাঞ্চলে। বোধকরি, এটি একটি ছোঁয়াছে রোগ; যেমন আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা নামের শেষাংশে পদবি হিসেবে ত্রিপুরা কিংবা চাকমারা নামের পদবী হিসেবে চাকমা শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। সিলেটাঞ্চলের আদিবাসী মুণ্ডাদের পদবি থাকলেও মুণ্ডা শব্দটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

একইভাবে বাউরি, তাঁতি, কাহার, নায়েক, কৈরী, হাজং, মাহাতো জনগোষ্ঠী নামের পদবি হিসেবেও সচরাচর ব্যবহার করে থাকেন। আদিবাসী সাঁওতাল কিংবা উরাঁওদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিকে ১২টি পদবির মধ্যেই অন্তর্ভুক্তি হতে হবে। আর উরাঁওদের অর্ধশতাধিক পদবি রয়েছে, যেমন টপ্প্য, কুজুর, কেরকেটা, এক্কা প্রভৃতি।

তবে কেউ যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাঁওতাল পদবি ব্যবহার করে, সেক্ষেত্রে সামাজিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনে সুবিধা থেকে অসুবিধাই বেশি হয়। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ অন্য জেলাগুলোতে বসবাসরত আদিবাসী সাঁওতালদের পদবি ধারণ করে টিএনও ও ডিসির কার্যালয় থেকে সার্টিফিকেটপ্রাপ্তিতে বেগ পেতে হয় না। তাহলে কেন হবিগঞ্জ, মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগান, সুরমা চা বাগান, জগদীশপুর চা বাগান, বৈকণ্ঠপুর চা বাগান ও নোয়াপাড়া চা বাগানে কর্মরত আদিবাসী সাঁওতালদের পদবিতে ‘সাঁওতাল’ শব্দটি ব্যবহার ব্যতিত সার্টিফিকেট প্রদানে ব্যতয় ঘটবে!

দ্বিতীয়ত, উপজেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আদিবাসী সাঁওতাল শিক্ষার্থী কিংবা চাকুরি প্রত্যাশিত সংযুক্তিতে আদিবাসী সার্টিফিকেটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন, গেজেটে নামের শেষে ‘সাঁওতাল’ কিংবা পদবির নাম উল্লেখ থাকা আবশ্যিক। গেজেটে অনুপস্থিত থাকলে কোনোভাবেই সার্টিফিকেট প্রদান করা সম্ভবপর নয়। আশ্চার্যন্বিত হই যে, একজন বিসিএস ক্যাডার যিনি দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী, ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে সামান্যতমও ওয়াকিবহাল নন। এটি দোষের নয় কিন্তু একটি আদিবাসী বসবাসকারী উপজেলার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বাহ্নে উপজেলার খুঁটিনাটি জানা দরকার। দেশের স্বনামধন্য গবেষক, লেখক, ঐতিহাসিক, ঔপনাস্যিক আদিবাসীদের নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ, প্রামাণাধি নিয়ে জাতিকে উপস্থাপন করেছেন। একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তা হিসেবে এগুলো সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করা সময়োপযোগী। কেননা দায়িত্ববান কর্মকর্তার গাফলতিতে অসংখ্য শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ধুলিস্যাৎ হতে পারে; একজন চাকরিপ্রত্যাশীর স্বপ্ন ভেঙে খান খান হতে পারে। আদিবাসী সাঁওতালদের পশ্চাৎপদতার নৈতিক দায়ভারকে এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত, উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে সার্টিফিকেটপ্রত্যাশীদের জানান দিচ্ছেন, যেসব আদিবাসী সাঁওতালরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন; তাদের সাঁওতাল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। এখানে স্মর্তব্য যে, অত্র অঞ্চলের খ্রিস্টানুসারী সাঁওতালরা ইতোমধ্যেই কয়েক প্রজন্ম ধর্ম হিসেবে ‘খ্রিস্টিয়ান’ অতিক্রান্ত করেছেন। ধর্ম পরিবর্তনে জাতিস্বত্ত্বা পরিবর্তনীয় নয় এরূপ নজির ভারতের হাইকোর্টগুলো থেকে একাধিক রায় রয়েছে। কারমু হাঁসদার মোকাদ্দমায় প্রশ্ন তোলা হয় যে কারমু হাঁসদার পিতৃ পুরুষ প্রায় সত্তর বৎসর পূর্বে খ্রিস্টিয় ধর্ম গ্রহণ করে এবং কারমু হাঁসদা বংশানুক্রমে খ্রিস্টান।

এ কারণে যুক্তি উপস্থাপন করা হলো যে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সপ্তম ক অধ্যায়ের আইন কারমু হাঁসদাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কোলকাতা হাইকোর্ট এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, “Change of religion does not change the aboriginal status of Santal and as such transfer by a Santal embracing Christianity is void without permission from the revenue officer “ (Kermoo Hasda vs Phanindra Nath Sarker 4 ICWN 32).

পাটনা হাইকোর্টও এ সংক্রান্ত রায় দিয়েছে। বলা হয়েছে, একজন আদিবাসী সাঁওতাল তার পছন্দ অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন, তাতে তার আদিবাসীত্বের বা তদানুযায়ী অধিকারসমূহের কোনও হেরফের ঘটে না। অযথা ধর্মকে টেনে এনে নিজেদের মধ্যে বিভ্রান্তি, বিভেদ ও অনৈক্যের কারণে সুযোগ সন্ধানীরা লাভবান হচ্ছে।

চতুর্থত, চা বাগানে কর্মরত ও বসবাসরত আদিবাসী সাঁওতাল, উরাঁও শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত কষ্ট করে পড়াশোনা করে থাকে। কখনো কখনো না খেয়ে থেকেও বিদ্যালয়ে গমনা গমন করে থাকে। চা বাগানের আদিবাসী প্রজন্মরা সম্ভুকগতিতে শিক্ষার দিকে ধাবিত হচ্ছে, প্রত্যেকেই পরিবারের প্রথম শিক্ষার্থী। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে যদি প্রতিরোধের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে; তাহলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার চেয়ে চায়ের কর্মী হিসেবেই একসময় মনোযোগী হবে। চা বাগানের উপযোগী পরিবেশ, উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও মানসম্মত এবং বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে বাগানের কর্মীকেও শিক্ষিত হতে হবে। আর সেই পথটিও যদি রুদ্ধ হয়, তাহলে দক্ষকর্মী হিসেবে নিজেদেরকেও টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হবে।

২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল প্রকাশিত গেজেটে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন বলে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীকালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশে। অথচ জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত ৩০ সদস্যবিশিষ্ট আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস কমিটি জাতীয় সংসদে ৭৫টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম গেজেটভুক্তির প্রস্তাবনা রাখে। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, ‘সমতল ভূমিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকরা বাদ পড়ে যাওয়ায় এর আগে প্রকাশিত গেজেট সংশোধনের জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা বাংলাদেশের নাগরিক, তাই তারা সত্যিকার নাগরিক হিসেবে দেশে বসবাস করবে এবং সব অধিকার ভোগ করবে।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘোষিত শিক্ষাবৃত্তির আবেদনের শেষ দিনক্ষণটি ছিল ১৫ মে, ২০২৪ খ্রি.। উপজেলার নির্বাহী অফিসার বিশেষত আদিবাসী সাঁওতাল ও উরাঁও শিক্ষার্থী আদিবাসী সার্টিফিকেট প্রদানে লাল ফিতার বন্ধনে বেঁধে ফেলেছেন। এটিতে কী কোনো দূরভিসন্ধি রয়েছে! প্রশাসনের কেউ কি আদিবাসী/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীবিরোধী! প্রশাসনের কেউ কি আগ্রহী নন আদিবাসীদের শিক্ষান্নোয়নে! এর আগে মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আন্তরিকতার সঙ্গে আদিবাসীদের কথা শ্রবণের পর যুক্তিসঙ্গতভাবেই সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। পূর্বের কর্মকর্তাকে অনুসরণ না করে নতুন ধ্যান-ধারণা ও পদ্ধতির অবতারণা করে আদিবাসী সাঁওতাল শিক্ষার্থীদের বঞ্চিতকরণের বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।

[লেখক : কলামিস্ট]

সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি:।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট সোর্স লিংক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ