পুলক ঘটক
প্যালেস্টাইন নামক একটি রাষ্ট্রের সম্ভাব্যতাকে আপাতত বাঁচিয়ে দিয়েছেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। তার একটি বাক্য “Palestinians must remain on their land” – ফিলিস্তিনিরা অবশ্যই তাদের নিজ ভূমিতে থাকবে – এই একটি কথাই প্যালেস্টাইন ও তার সম্ভাবনাকে এখনো জিইয়ে রেখেছে; এবং এই যুদ্ধে ইসরাইলের জয়ী হওয়ার সামগ্রিক সম্ভাবনা শূণ্যের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।
মানবিক কারণ দেখিয়ে মিসরের উপর প্রবল চাপ দেওয়া হয়েছিল; বলা হয়েছিল, রাফা সীমান্ত খুলে দিন, ফিলিস্তিনিরা জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, এমনকি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজে সিসিকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু সিসি’র এক কথা, “Palestinians must stay on their land”. তিনি বলেছেন, আমি রাফা ক্রসিং বন্ধ করিনি, তোমরা এই পথ দিয়ে যত ইচ্ছা ত্রাণ সামগ্রী গাজায় নিয়ে যাও, আমিও ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছি তোমরা নিয়ে যাও; কিন্তু গাজা থেকে একজন ফিলিস্তিনিও আমার দেশে ঢুকবে না। তারা তাদের নিজ ভূমিতে থাকবে। তিনি আরও পরিস্কার করে বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে শরণার্থী হয়ে গেলে প্যালেস্টাইনের সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। এটাই সত্য কথা। এটাই ইসরাইলিরা চাচ্ছিল; ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে বিতারিত করতে পারাই সহজ যুদ্ধ জয়।
গাজায় অভিযানের জন্য ইসরাইল সাড়ে তিন লাখ সৈন্যের এক বিশাল পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে রেখেছে। কিন্তু তিন সপ্তাহ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অভিযান শুরু করতে পারছে না। উপর থেকে বোমা ফেলছে, কিন্তু গাজার ভেতরে সৈন্য প্রবেশ করাচ্ছে না। কারণ কি? কারণ হচ্ছে, গাজার ভিতরে বিপুল সংখ্যক মানুষ। মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৩ লাখ মানুষের বাস। কত মানুষকে মেরে ফেলা যায়? তারা যদি পালিয়ে যেত, তবে গাজার প্রায় পুরোটা দখল নিয়ে ধীরে সুস্থে একটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের চিন্তা করা যেত। কিন্তু এই অবস্থায় সেখানে বিপুল মানুষকে হত্যা বা গ্রেপ্তার করে শান্তি ফেরানো মানবিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে যুৎসই হয় না; টেকশই হয় না। পৃথিবী তা মানবে না; শুধু ‘মুসলিম ব্রাদারহুড সেন্টিমেন্ট’ নয় – মানবিক সেন্টিমেন্টও এটা সহ্য করবে না।
শেষটা কি হবে বলা যায় না। তবে এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে; সম্ভাবনা আছে যুদ্ধটা আরও বহুদূর ছড়ানোর। আর মানুষের বিক্ষোভ ছড়াবে আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের কোনায় কোনায়।
এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহ নিয়ে হিসাব নিকাশ আছে। করোনা অতিমারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সেখান থেকে ইসরাইল-হামাস সমরকে বৃহত্তর যুদ্ধে রূপান্তরিত করে তার ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য বিশ্ব অর্থনীতির আছে কিনা হিসাব নিকাশ চলছে। সেনা অভিযানে বিপুল মানুষকে গ্রেপ্তার করে ইসরায়েলের জেলখানায় নিতে চাইলে তা সামলানোর দায় আছে; দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় বহন করার চাপ আছে। দুই দেশ তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে গায়ের জোরে পুরো ভূখণ্ডকে এক ইসরাইল রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসার মাধ্যমে জোর করেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, গণ-মনস্তাত্ত্বিক সম্ভাবনা কল্পনা করা কঠিন। এই সকল কঠিন সহজ হয়ে যেত, যদি ফিলিস্তিনিদের আরও বিপুল সংখ্যায় উদ্বাস্তু বানিয়ে মিসরের সিনান অঞ্চলে পাঠানো যেত। প্রেসিডেন্ড সিসি তাতে রাজি হননি; কঠোরভাবে নাকোচ করেছেন।
মানবিক কারণ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়ে যে চরম অমানবিক ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে, সিসি সেই ফাঁদে ধরা দেননি। বাংলাদেশ যদি পুরো মিয়ানমার সীমান্ত সিল করে দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতো, তাতে রোহিঙ্গাদের উপকারটাই বেশি হতো। যদি বলতো রোহিঙ্গারা মরুক, বাঁচুক, উদ্বাস্তু হোক – তারা তাদের ভূমিতে থাকবে। আমি প্রয়োজনে তাদের কাছে সব ধরনের মানবিক সাহায্য পাঠাবো; কিন্তু তাদেরকে তাবু গাড়তে হবে সীমান্তের ওপারেই – তাদের নিজ দেশে। মানবিক সেন্টিমেন্ট দেখাতে গিয়ে নয়; ‘মুসলিম ব্রাদারহুড সেন্টিমেন্ট’ দেখাতে গিয়ে সবকিছু নষ্ট করেছে বাংলাদেশ। এখন এই সমস্যা সমাধান করা সুদূর পরাহত।
এবার আরেক দিকে দৃষ্টি দেই। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দু অধিবাসী ছিল ১৪ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৭.৯৫ শতাংশ হিন্দু। একটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর বৈষম্য আছে, অবিচার আছে সন্দেহ নেই। এদেশে হিন্দুদের উপর টার্গেট করে হামলা চালানো হয়, কিন্তু সেসব হামলার বিচার হয় না– এ অভিযোগ সত্য। রাষ্ট্রীয় প্রতিকুল পক্ষপাত আছে, চাকরিতে বৈষম্য আছে, সামাজিক নিরাপত্তার সংকট আছে, সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা আছে – অনেক প্রতিকূল বাস্তবতা আছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে লড়াই না করে কোনো জনগোষ্ঠীর সুযোগ সন্ধানী মানুষেরা যদি শুধুমাত্র পারিবারিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনায় দেশান্তরিত হয়, তবে সেই জনগোষ্ঠীর কল্যাণ আকাশ থেকে ঝড়ে পড়বে, কিভাবে আশা করেন?
এই বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা অনেক হয়েছে; কিন্তু দাঙ্গা তো হয় না! হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়েছে কবে? ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে শুনবেন? গাজায় যখন ইসরায়েলি বোমা পড়ছে তখন ইসরায়েলের ভিতরেই সেখানকার সংখ্যালঘু ফিলিস্তিনিরা গত তিন সপ্তাহে অনেকগুলো বড় রকমের বিক্ষোভ করেছে, বহু গাড়ি ভেঙেছে, অনেককিছু তছনছ করেছে। তারা এটা করেছে সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি গ্রেপ্তার হয়েছে; গুলিতে প্রাণ দিয়েছে প্রায় এক শো। বলুন দেখি, বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় দেড় কোটি হিন্দু গত ৫০ বছরে এমন কয়টি বিক্ষোভ করেছে, যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে পড়ার মতো? এই দেড় কোটি সংখ্যাটি ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মোট জনসংখ্যার চেয়েও অধিক। অনেক সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার চাইতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। এই বিপুল সংখ্যক হিন্দু কি কখনো ফিলিস্তিনিদের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ সহ্য করেছে? নিশ্চয় নয়। তবে ফিলিস্তিনিরা খোদ ইসরায়েলের ভেতরে থেকেও প্রতিবাদ করে, অথচ, আমার বহু হিন্দু ভাই কোনোদিন একটি লাঠির বাড়ি না খেলেও পালায়! প্রতিবাদের পরিবর্তে নিজের পোটলা গুছিয়ে পালায় কেন? এটি কি একটি ভীরু ও দুর্বল মনোসামাজিক বৈশিষ্ট নয়? এ থেকে উন্নতির চেষ্টা করা উচিত কিনা? হামলা করলে হিন্দুরা পালাবে, হামলাকারীদের দখল সহজ হবে – সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে এই সহজ তত্ত্বটি বুঝতে দিয়েই হারছে হিন্দুরা।
যা হোক, সম্প্রতি হিন্দুদের কতিপয় সংগঠন নিজেদের মেয়েদের অধিকারের বিরুদ্ধে ছোটখাটো আন্দোলন করার নজির তৈরি করেছে। একদম নির্লজ্জ, লোভী, কাপুরুষোচিত ভূমিকায় নেমেছে। কিন্তু হিন্দুদের সংকটকে যখন অস্তিত্বের সংকট বলা হচ্ছে, তখন অস্তিত্ব রক্ষায় মাত্র ৫০ হাজার হিন্দুও কি কখনো রাজপথে নেমে এসেছে? গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ কই? সংখ্যালঘুদের বিক্ষোভ দমাতে সরকার কি কখনো শত শত হিন্দুকে গ্রেপ্তার করেছে? কয়জন হিন্দু কবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে? গণতান্ত্রিক নিয়মে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার অধিকার সবার আছে। যারা নিজ ভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ না করে পালায়, তারা কি কখনো জয়ী হয়?
জনগণের প্রাণশক্তি আমেরিকা-ইসরায়েলের সামগ্রিক সমর শক্তির চেয়েও বেশি। সেই প্রাণশক্তির ভয়েই ইসরাইল এখন পর্যন্ত গাজায় স্থল অভিযান শুরু করতে পারেনি। কিন্তু সেই প্রাণশক্তি যদি ঘনিভূত না হয়ে, প্রত্যেকে নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালায় তখন পরাজয় হয় ত্বরান্বিত। যারা লড়তে জানে, মরতে জানে, জীবন দিয়ে গড়তে জানে- তারা কখনো হারে না। জয় মানুষ।