পুলক ঘটক
হিন্দু আইন সংক্রান্ত এই সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো একত্রে মিলিয়ে নিন এবং সমাজ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিন। হিন্দু আইন সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার মতামত যুক্তিসঙ্গত কিনা ভেবে বলুন।
বাংলাদেশে হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিয়ে দেওয়া কি বৈধ?
হ্যাঁ বৈধ। কবে থেকে বৈধ? যখন বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়েছে, তার পর থেকে বৈধ। তার আগে বিধবাদের বিয়ে দেওয়া অবৈধ ছিল। ইংরেজ শাসনামলে ১৮৫৬ সালে বিধবাদের বিয়ের আইন (The Hindu Widow’s Re-marriage Act, 1856) পাশ হয়েছে। সে আইন বাংলাদেশে এখনো চালু আছে।
বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ কি বৈধ?
না বৈধ নয়। কারণ বাংলাদেশে চলমান প্রথানির্ভর হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই। যখন বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাশ হবে, তারপর বৈধ হবে।
তাহলে আমরা যে হিন্দুদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের অনেক ঘটনা দেখি, সেগুলো কিভাবে হয়?
বেআইনীভাবে হয়; অবৈধভাবে হয়। সমাজে অনেক কিছুই অবৈধভাবে চলছে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ অবৈধপথে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর হিন্দু মেয়েদের অন্যখানে বিয়েও তো দেওয়া হচ্ছে! সেগুলো কিভাবে হচ্ছে?
অবৈধভাবে হচ্ছে। বাংলাদেশে হিন্দু নারীর এরকম দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে আইনগত দিক থেকে একদম অবৈধ। ফলে তাদের মেলামেশা ও সংসার যাপন আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। বিয়ে না করে ‘লিভ ইন’ বা ‘লিভ টুগেদার’ করার মতোই ব্যাপার! এরকম দম্পতির মেলামেশার ফলে যে সন্তান জন্ম হচ্ছে তাও আইনত অবৈধ। হিন্দু আইনে অবৈধ সন্তান (পুরুষ হলেও) সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পায় না।
কোন প্রথা হিন্দু আইন এবং কোনটা আইন নয় তা কিভাবে বুঝব?
বোঝার সহজ উপায় হল, অতীতে (প্রায় সবই বৃটিশ আমলে) বিভিন্ন আদালতের রায়ের মাধ্যমে যে সব সংস্কৃতি প্রথাগত আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেগুলোই এখন চলছে। বাংলাদেশে মোটাদাগে দুই ধরনের হিন্দু আইন চালু আছে – ১. ইংরেজ আমলে পাশকৃত কিছু সংবিধিবদ্ধ (codified) আইন এবং ২. কিছু প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর প্রথা – যা আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
১৯৪৬ সালের Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946 একটি সংবিধিবদ্ধ হিন্দু আইন। এই আইনে বিবাহিত নারীকে দুবৃত্ত স্বামীর কবল থেকে বাঁচার জন্য আলাদাভাবে বসবাস করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে বিবাহবিচ্ছেদ (divorce) ঘটিয়ে পুনরায় বিয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার দেওয়া হয়নি। নারীকে তার পরিত্যক্ত স্বামীর পরিচয়েই ‘সতী’ হয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের দরকার হয় না। কারণ সে চাইলে যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে; বিচ্ছেদ লাগে না, সতীত্ব লাগে না।
পুরুষের বহুবিবাহের অধিকার বিষয়ে কোনো লিখিত আইন আছে কি?
না, এটাও ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর প্রথাগত আইন। হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রণে কোনও আইন হয়নি, তাই প্রথা বলবৎ আছে।
হিন্দুদের ধর্মীয় শাস্ত্রে বিবাহবিচ্ছেদ এবং নারীর পুন:বিবাহের বিধান আছে কিনা?
হ্যা, আছে; সুস্পষ্ট বিধান আছে। কিন্তু ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত হিন্দু আইনে সেই শাস্ত্রবিধান মানা হয়নি।
বাংলাদেশে ‘গে ম্যারেজ’ বা সমকামীদের মধ্যে বিবাহ বৈধ কিনা?
না, বৈধ নয়। কোন আইনে অবৈধ? প্রথাগত আইনে এর বৈধতা নেই এবং এমন বিয়েকে বৈধতা প্রদান করে কোনো সংবিধিবদ্ধ আইন হয়নি। তাই অবৈধ।
হিন্দু আইনে অসবর্ণ বিবাহ কি বৈধ?
না বৈধ নয়; অবৈধ। ইংরেজ শাসনের শেষ সময়ে ১৯৪৬ সালে The Hindu Marriage Disabilities Removal Act, 1946 প্রণয়ন করা হয়েছিল। ঐ আইনে শুধু একই জাতি/বর্ণের বা গোত্রের মধ্যে যেসব উপবিভাগ রয়েছে তাদের মধ্যে বিয়ে বৈধ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণের ছেলে/মেয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্রের ছেলে/মেয়ের বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়নি।
কিন্তু ইদানিং যে অনেক অসবর্ণ বিয়ে হচ্ছে, সেগুলো কিভাবে হয়?
অবৈধভাবে হয়। এই বিয়েগুলো অবৈধ, তাদের মেলামেশা বা ‘লিভ টুগেদার’অবৈধ এবং তাদের সন্তানরাও আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ সন্তান। অবৈধ সন্তানরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না।
তাই ভেবে বলুন, বাংলাদেশেও একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুসঙ্গত হিন্দু বিবাহ আইন প্রণয়ন করে বিবাহবিচ্ছেদ, নারীর পুনবির্বাহ এবং অসবর্ণ বিয়ের বৈধতা প্রদান দরকার কিনা? হিন্দু আইন বদলানো যায় কিনা?
ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে হিন্দু আইন বহুবার পরিবর্তন হয়েছে; এমনকি নতুন নতুন হিন্দু আইন হয়েছে। একেক দেশে ও একেক অঞ্চলে একেক রকম হিন্দু আইন আছে। আজকের যুগের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজকের যুগে।