আজ একটি ঐতিহাসিক দিন; এক বিস্মৃত ভয়াবহ ইতিহাস সমাপ্ত করার দিন। ১৯৪ বছর আগে আজকের দিনে (১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর) পাস হয়েছিল স্বামীর চিতায় হিন্দু নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা নিষিদ্ধকরণের আইন –The Bengal Sati Regulation, 1829.
সেদিন যদি সতীদাহ নিষিদ্ধের আইন পাশ না হতো, তবে আধুনিক যুগে হয়তো ঘন ঘন সতীদাহের ঘটনা ঘটতো না; বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও মেয়েদের পুড়িয়ে মেরে শাস্ত্র অনুযায়ী মহাপুণ্য অর্জনের কাজ হতো। সে ঘটনা সারা পৃথিবীর মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশ হতো। তাতে হিন্দু সমাজকে আজকের যুগের মানুষ কি বলতো? শব্দটা উচ্চারণ করতে চাই না।
দুই শো বছর পর আমরা যখন আজ হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তিতে সমঅধিকারের দাবিতে কথা বলছি, তখন সেদিনের সেই কুর্কীর্তির ইতিহাস গোপন করার জন্য একদল লোক মরিয়া। সে ইতিহাসের কথা বললে আজ দুর্বৃত্তরাও লজ্জা পায়। এই লজ্জা ভাল। কিন্তু দু:খজনক সত্য হল, যে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নারীকে জীবন্ত পোড়ানো হতো, আজ সেই শাস্ত্রের দোহাই দিয়েই ওরা মেয়েদের অধিকার হরণ করতে চায়। হিন্দুদের যেসব শাস্ত্র সাম্যের কথা বলে, বৈষম্য ও ভেদাভেদের ঊর্ধে ওঠার আহ্বান জানায়, স্বার্থের প্রশ্নে সেই শাস্ত্র ওরা ভুলে যায়।
বিদ্যমান হিন্দু আইনের কোথাও বেদ, উপনিষদ অথবা গীতা থেকে একটি শ্লোকও রেফারেন্স হিসেবে পাওয়া যায় না। যে শাস্ত্রগ্রন্থ বা সংহিতাগুলো মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয়নি; মানুষকে নারী, শূদ্র, ম্লেচ্ছ, চন্ডাল, অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য ও জ্ঞানলাভের অযোগ্য (বেদপাঠের অযোগ্য) ঘোষণা করেছে; সেসব শাস্ত্রেই মানুষকে পুড়িয়ে মারার (সতীদাহ) বিধান রয়েছে।
হিন্দু আইনের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত ‘দায়ভাগ’ নামক বইটিতে শুধু ঐসব বৈষম্যের শাস্ত্র থেকেই উদ্ধৃতি আছে –বেদ, উপনিষদ বা গীতার কোনো রেফারেন্স নেই। অন্যদিকে ইংরেজরা যেসব সংবিধিবদ্ধ (codified) হিন্দু আইন বানিয়েছে এবং বহুবার সংশোধন করেছে তাতে কোনও শাস্ত্রেরই উদ্ধৃতি নেই। আরেকটি মজার বিষয় হল, হিন্দু আইন সর্বত্র একরকম নয়; বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার।
এতসব জেনে বুঝেও যারা মেয়েদের অধিকারের বিরোধিতার জন্য ধর্মের দোহাই দেয়, তারা নি:সন্দেহে সেই সতীদাহের পক্ষে লড়াই করা পশুদেরই অপজন্মা পাপাত্মা। শাস্ত্রজ্ঞানহীন এবং আইন সম্পর্কে একদম অনভিজ্ঞ মানুষদের দোষ দেই না। কিন্তু যারা জেনেবুঝে বিরোধিতা করছে তাদের ভাল বলার সুযোগ নেই। তারা প্রগতির শত্রু; সমাজ ও মানুষের শত্রু।
রাজা রামমোহন রায়, উইলিয়াম কেরি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকসহ সতীদাহ নিষিদ্ধে অবদান রাখা মানবের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাই।