ক্ষেত্রজ সন্তান জন্মানোর নীতি আলোচনা

পুলক ঘটক

বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপে গতকাল (জানুয়ারী ৪, ২০২৪) লিখেছিলাম,
“হিন্দু আইনে নারী পুরুষের ক্ষেত্র। সরাসরি এই ‘ক্ষেত্র’ শব্দটিই শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। সেই ক্ষেত্র আবার অন্যকে ভাড়া দিয়ে ‘ক্ষেত্রজপুত্র’ জন্মানো যায় -এমন বিধান আছে। এই ব্যাপারটা আপনাদের কেমন লাগে?”
অনেকেই সেখানে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আমি যে আলোকে প্রশ্নটি করেছিলাম উত্তরগুলো খুব কমই সে আলোকে এসেছে। মানবসভ্যতার যে গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন এর মধ্যে নিহিত আছে তা উপেক্ষা করে সন্তান জন্মদান তথা যৌনবৃত্তি নিয়ে চটুল আলোচনাতেই অধিকাংশ মন্তব্যকারীর মনোনিবেশ দেখে হতাশ হয়েছি।
এখানে প্রথম ও সহজ দিকটি হল, ক্ষেত্রজ সন্তান জন্মানো আমাদের দেশের লালিত মূল্যবোধ ও সমাজবোধের সঙ্গে যায় না। তাই সেদিক থেকে এটি অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু সমাজসংস্কৃতি যেহেতু স্থবির ও অপরিবর্তনীয় নয়, তাই এটাকেই চরম হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। অতীতের সমাজে যে জিনিসটি স্বাভাবিক ছিল, আজকের সমাজের চোখে তা খারাপ মনে হচ্ছে; ভবিষ্যতে হয়তো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়টিকে অন্যভাবে নেবে। এ হলো একটি দিক।
কিন্তু সবচেয়ে সিরিয়াস দিক হলো নারীকে পুরুষের মালিকানাধীন ক্ষেত্র হিসেবে দেখা। কোনও নারী তার নিজ প্রবৃত্তিতে, নিজের অভিরুচি অনুযায়ী, নিজের সিদ্ধান্তে, স্বেচ্ছায় যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান জন্ম দেয়, তাকে কিভাবে দেখবেন এবং অন্যের মালিকানাধীন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হলে তাকে কিভাবে নেবেন? মূল প্রশ্ন সেখানে।
মুল প্রশ্ন হল, নারী অপরের ক্ষেত্র কিভাবে হতে পারে? সে একজন মানুষ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতা, চাহিদা, স্নেহ-মমতা, প্রেম এবং দু:খ-সুখের বোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। ভাল-মন্দ মিলিয়ে সে একজন মানুষ। সে অন্যের ক্ষেত্র নয়, অন্যের যন্ত্র নয়, অন্যের মালিকানাধীন পণ্য নয়। সে স্বাধীন মানুষ।
যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে হয়, সে সিদ্ধান্ত একজন নারী নিজে নেবে। সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত অথবা কোনও পুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়া বা না হওয়ার সিদ্ধান্ত একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর নিজের বিষয়। তার দেহ এবং তার মনের উপর তার নিজের অধিকার।
কিন্তু ক্ষেত্রজ সন্তান জন্মদানের বিষয়টি একজন নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়; তার নিজের ভাললাগা বা রুচির বিষয় নয়। তার দেহ এবং তার মন অন্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। নারী স্বেচ্ছায় তার পছন্দের কারও সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন করলে তাকে নিন্দা করবেন, কিন্তু অন্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হলে তাকে মহিমান্বিত করবেন –এ কেমন কথা?
মহাভারতে রাজা বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় মারা যাওয়ার পর বংশ রক্ষার জন্য তার দুই বিধবা স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান জন্মানোর জন্য মহামুনি ব্যাসদেবকে নিয়োগ করা হয়েছিল। ওনাকে ডাকার কারণ হল, মহর্ষি বেদব্যাস ছিলেন সম্পর্কে বিচিত্রবীর্যের বড় দাদা –রাজা শান্তনুর কানীন পুত্র। শান্তনু বিয়ে করার আগে কুমারী অবস্থায় মৎস্যগন্ধা পদ্মাবতির গর্ভে পরাশর মুনির ঔরসে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের জন্ম। সেই সূত্রে উনি রাজা শান্তনুর কানীন পুত্র। পুরুষতান্ত্রিক পরম্পরাকে বংশ মানলে তিনি জিনেটিক্যালি ঐ বংশের কেউ নন। অথচ তার জিনেই বংশরক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, অম্বিকা ও অম্বালিকা স্বেচ্ছায়, স্বাগ্রহে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হতে যাননি। অন্যদের দ্বারা তাড়িত হয়ে তারা বিব্রতকর ও বিদ্ঘুটে কর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, যৌনমিলনের সময় তাদের একজন ভয়ে চোখ বন্ধ করেছিলেন। যে কারণে তিনি অন্ধ পুত্র ধৃষ্টরাষ্ট্রকে জন্ম দিয়েছেন। অন্যজন লজ্জায় ও ভয়ে ফ্যাকাসে বা পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেছিলেন। ফলে তার গর্ভে পাণ্ডু জন্ম নিয়েছেন। নারীর অভিরুচি এবং ভাললাগা বা মন্দলাগার বিরুদ্ধে এ এক চুড়ান্ত অবমাননা।
শাস্ত্রীয় নিয়োগ প্রথায় কিছু হাস্যকর, অবান্তর শিশুতোষ শর্ত দেওয়া আছে– যাতে ক্ষেত্রজ সন্তান জন্মদানের জন্য নারী-পুরুষ মিলিত হলেও তাদের মধ্যে কামভাব না থাকে। বিধবা নারীকে দিনের পর দিন উপবাস ও ব্রত পালন করিয়ে বা নিরামিষ খাইয়ে নিস্কাম বানানোর আহাম্মকি প্রয়াস যেমন, তেমনই কিছু অবৈজ্ঞানিক শর্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে জুড়ে দেয়া হতো। এসব করে প্রানীদেহের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নাশ করা যায় না। গরু, ছাগল, হরিণ, মহিষ, হাতি ইত্যাদি নিরামিষ খায় বলে তারা প্রজনন প্রবৃত্তির বাইরে নয়।
লক্ষ্য করুন, প্রয়াত বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীদের উপর ব্যাসদেবের মতো মহাতপস্বীকে নিয়োগ করা হলেও মিলনের সময় ওনার ঐ দুই নারীতে সন্তোষ হয়নি। দুইজনের পরে একজন দাসীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি বিদুরকে জন্ম দিয়েছিলেন। কখনোই কোনও শর্ত দিয়ে যৌনমিলনকে কামহীন করা যায় না। একমাত্র ইডিয়েট ছাড়া এসব শর্তের যৌক্তিকতা কেউ গ্রহণ করবে না। তাছাড়া সম্পর্ক অযৌন হলে ভাল ও পবিত্র, কিন্তু যৌন হলেই খারাপ– এগুলো অবান্তর ধারণা।
ক্ষেত্রজ সন্তানের কনসেপ্টের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হল, নারীকে স্বাধীন মানুষ মনে না করে অন্যের ক্ষেত্র মনে করা; তার মানবিক স্বত্তা অস্বীকার করা। এই কনসেপ্টের ভিত্তিতে প্রণীত যে আইন তা মানবতা পরিপন্থী ও ভয়াবহ বৈষম্যমূলক হতে বাধ্য।
এর সঙ্গে সন্তানের অভিভাকত্ব আইন এবং উত্তরাধিকার আইনসহ সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কভিত্তিক অন্যান্য আইনের সরাসরি সম্পর্ক আছে। যে নারী তার নিজের জিন দিয়ে ভ্রুণ উৎপাদন করে নিজ গর্ভে তাকে লালন করলেন, সেই সন্তানের অভিভাবক হওয়ার অধিকার সেই নারীর নেই। সন্তান ঐ নারীর বংশের কেউ হবে না। সন্তান হবে ঐ নারীটি যার মালিকানাধীন, সেই পুরুষের বংশের একজন! এমন কি যে পুরুষ লোকটি সন্তান জন্ম দিলেন সন্তান তার বংশেরও কেউ হবে না। বীর্য যার সন্তান তার নয়, বরং ক্ষেত্র যার সন্তান তার– বিভিন্ন সংহিতা শাস্ত্রে এই নীতি উল্লেখ আছে।
সেযুগে নারীকে ক্ষেত্র এবং বিবাহিত স্বামীকে সেই ক্ষেত্রের মালিক মনে করা হতো। তবে কার্যক্ষেত্রে ব্যত্যয় আছে। বীর্য যার সন্তান তার এবং ক্ষেত্র যার সন্তান তার– এই উভয় নীতির একধরনের মৌখিক পরিচিতি শাস্ত্রে পাওয়া যায়। মহর্ষি বেদব্যাস একাধারে পরাশর পুত্র এবং মহারাজা শান্তনুর কানীন পুত্র – এই উভয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর –এই তিনজন একাধারে বিচিত্রবীর্যের পুত্র এবং ব্যাসদেবের পুত্র হিসেবে স্বীকৃত। যুধিষ্ঠিরকে পাণ্ডুপুত্র এবং ধর্মপুত্র উভয়ই বলা হয়েছে। অর্জুনকে দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র এবং পাণ্ডুপুত্র দুটোই বলা হয়েছে। কর্ণকে মহাভারতে সূর্যপুত্র বলা হলেও শেষ পর্যায়ে এসে প্রয়াত রাজা পাণ্ডুর কানীন পুত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ধর্মে, প্রাচীন এমনকি আধুনিক সমাজেও নারীর প্রতি নানাবিধ বিদ্ঘুটে ধারণা বিরাজমান -নারীনিপীড়নমূলক পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। গর্ধব-মগজীয় ধর্মরক্ষক বীরেরা যখন কার ধর্মে নারীকে বেশি মর্যাদা দিয়েছে তর্ক করে, তখন হাসি পায়। নারীকে বেশি মর্যাদা দিতে হবে না। মানুষ হিসেবে সমমর্যাদা দিন। নারী-পুরুষ সম-মর্যাদার পৃথিবী গড়াই সভ্যতার দাবি। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে শিক্ষিত দাদা-দিদিদের প্রতি আমার আহ্বান, নারীকে ক্ষেত্র বিবেচনা করার প্রাক্তন মতাদর্শকে প্রতিমুহুর্তে চ্যালেঞ্জ করুন। নারী ক্ষেত্র নয়, পন্য নয়, অন্যের যন্ত্র নয়; নারী মানুষ। তাই নারীকে দান করে দেয়া, বিক্রি করা, অপহরণ করা থেকে শুরু করে অতীত ও বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতির পাতায় পাতায় মিশে থাকা অমানবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করুন।
উন্নত মানুষ হওয়ার জন্যই প্রচলিত অন্যায় ও ভ্রান্ত সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করা একজন সঠিক মানুষের দায়িত্ব।
নবমূল্যায়নে মহাভারত ও অন্যান্য শাস্ত্র পাঠ করুন। একলব্যের গুরুভক্তির প্রশংসায় গদ গদ হওয়ার সময় গুরুদক্ষিণা নেওয়ার অজুহাতে একজন মানুষের আঙ্গুল কেটে নেওয়ার মতো বিভৎস নিষ্ঠুরতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করুন। নিম্নবর্ণের মানুষ হওয়ায় একলব্যকে অস্ত্র শিক্ষা না দেয়া এবং আঙুল কেটে নিয়ে একজন বীরের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়ার মতো হীনকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রকৃত সনাতনী হন। পরিবর্তন ও উন্নতিই সনাতন ধর্ম।
এই প্রযুক্তির যুগে সারা পৃথিবী আজ আপনার হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানই মা সরস্বতীর অঙ্গ। প্রাচীন বৈদ্যবিদ্যা বা আয়ুর্বেদ যেমন বেদ (জ্ঞান), আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যাও তেমনি বেদ। আধুনিক উন্নত সমাজ বিদ্যাও বেদ। এই বেদকে ধারণ করলে এবং উন্নততর সত্যের উন্মেষকে গ্রহণ করলে সনাতন ধর্ম পালন করা হয়। যুগধর্ম সনাতন ধর্ম। প্রাচীনকে ও ভুলকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সনাতন ধর্ম আপনাকে এই অধিকার দিয়েছে। পরিবর্তন অনিবার্য।
নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ধাবন, নতুন অর্থনৈতিক প্যাটার্ন এবং বিভিন্ন সমাজের পারস্পরিক দেয়া নেয়া এবং নতুন নতুন বাস্তবতার কারণে সমাজ মননে, মূল্যবোধে এবং আইনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আজ যেমন টেস্টটিউব বেবি এবং সারোগেট মাদারহুড (একজনের জরায়ু থেকে অন্যের গর্ভে ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের প্রযুক্তি) বা বিকল্প মাতৃত্বের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, অতীতে তা ছিল না। সামনে আরও নতুন আসবে। মনে রাখবেন সনাতন ধর্ম সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে আধুনিক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ