পুলক ঘটক
এককভাবে পুরুষদের হাতে সম্পত্তি ও কর্তৃত্ব থাকায় বাংলাদেশে হিন্দুদের বিপর্যয় ঘটেছে। হিন্দুরা সংখ্যায়, সামর্থ্যে ও সম্পদে কমে গেছে। হিন্দুদের ব্যর্থতার সামগ্রিক দায় পুরুষ নেতৃত্বের; নারীর নয়। উন্নত ও টেকসই হতে হলে সমতার সমাজ প্রয়োজন।
প্রশ্ন: বিপর্যয়ের জন্য পুরুষ নেতৃত্ব দায়ী কিভাবে বলছেন? এর প্রমাণ কি?
উত্তরঃ এটাতো প্রত্যক্ষ প্রমাণ; একদম দৃশ্যমান সত্য। আজ থেকে ৭০০ বছর আগে বাংলায় হিন্দু+বৌদ্ধ ছিল ১০০%। এখন হয়েছে ৭.৯৫%। এই ৭০০ বছর যাবত সম্পত্তি এবং সমাজ ও পরিবারের কর্তৃত্ব কার হাতে ছিল? নারীর হাতে ছিল, নাকি পুরুষের হাতে? তাহলে এই অবস্থা কিভাবে হল? দায় কার? সম্পূর্ণ দায় তো পুরুষের। গোপনে জমি বিক্রি করে ভিন্ন ধর্মের মানুষের হাতে তুলে দিয়ে রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে পালানোর কর্তা কে? নারী না পুরুষ? ইতিহাস স্বাক্ষী, পুরুষদের ধর্মান্তরিত হওয়ার রেকর্ড অনেক বেশি। ইদানিং প্রেমঘটিত বা অন্য কোনো ঘটনাচক্রে কোনও একজন নারী ধর্মান্তরিত হলে সে একা যায়। কিন্তু একজন পুরুষ ধর্মান্তরিত হলে গোটা পরিবারকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। পুরুষের হাতে সব সম্পত্তি ও পরিবারের কর্তৃত্ব থাকায় পরিবারের নারী, শিশু এবং বয়স্করা সবাই সবদিক থেকে অসহায় হয়ে পরে। বাধ্য হয়ে তাদেরকে ঐ ধর্মত্যাগী পুরুষের অনুসরণ করতে হয়। অতীতে যখনই হিন্দু পুরুষরা রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় অথবা নিগ্রহ থেকে বাঁচতে ধর্মত্যাগ করেছে, তখন তাদের পরিবারগুলিও বাধ্য হয়েছে। অতীতে পুরুষ-নেতৃত্বে ধর্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছে দলে দলে। এখন বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত কিছু ধর্মত্যাগের ঘটনা ঘটে থাকে এবং এখনো তাতে পুরুষপ্রাধান্য। হিন্দু পরিবারে এবং সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন এখনো হয়নি। হিন্দুদের দেশত্যাগের ক্ষেত্রেও ছেলেরা এগিয়ে এবং তার সাথে পরিবারের কর্তার সিদ্ধান্ত প্রধান। এভাবে বাংলাদেশে হিন্দু কমেছে; মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে। হিন্দুদের এরকম দুর্বল অবস্থা তো আগে ছিল না! তাহলে কার নেতৃত্বে এই অবস্থা হল? নারীদের নেতৃত্বে না পুরুষদের নেতৃত্বে? হিন্দুদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিক ব্যর্থতার জন্য নারীদের দায়ী করার সুযোগ নেই এবং সেই অজুহাতে নারীর অধিকার কেড়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং ব্যর্থতার দায়ে কারও অধিকার কেড়ে নিতে হলে সেক্ষেত্রে পুরুষদেরই নৈতিক দাবি থাকে না। পুরুষদের অক্ষমতার কারণে এবং মেয়েদেরকে অধিকারহীন, আশ্রিত ও নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী বানিয়ে রাখার কারণে সমাজ দুর্বল হয়েছে। এভাবে হিন্দু সমাজকে একদম প্রান্তিক পর্যায়ে ফেলার দায় পুরুষের। ব্যর্থতার এ দৃষ্টান্ত আপনার-আমার চোখের সামনে রয়েছে। শুধু দেখার ও উপলব্ধির চোখ নেই। সে কারণে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে সমাজ। মেয়েদের অধিকার দিয়ে সক্ষম ও স্বাবলম্বী বানিয়ে অর্থনীতি ও সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসা না হলে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত নিঃশেষ হবে; আরও বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।
প্রশ্ন: সমাধান কি?
উত্তর: নারীর ক্ষমতায়ন। হিন্দু নারীর ক্ষমতায়নই হিন্দু সমাজকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। আমাদের বর্তমান যে মানব সম্পদ আছে, নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তা দ্বিগুণ হবে। আইনের মাধ্যমে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হলে হিন্দু সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। পরিবর্তনটা হয়তো এক রাতে হবে না। কিন্তু দশ বছরের মধ্যে সমাজের বড় রকমের অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।
প্রশ্ন: নারীর ক্ষমতায়ন করতে গিয়ে যদি নারী অপহরণের ঘটনা বেড়ে যায়?
উত্তর: উল্টোটা হবে। নারী অপহরণ, নারীদের উপর অন্যায়, জুলুম ও ধর্মত্যাগের ঘটনা কমবে। বর্তমানে কোনো নারী ধর্মত্যাগী হলে পরিবারকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া তার ব্যক্তিগতভাবে হারানোর তেমন কিছু নেই। কিন্তু নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, ধর্মত্যাগের সঙ্গে তাকে পৈত্রিক উত্তরাধিকারও হারাতে হবে। ফলে তার জন্য ভিন্নধর্মের পুরুষের সঙ্গে যাওয়া কঠিন হবে।
এর সাথে নারীর ক্ষমতায়নের মনোস্তাত্তিক প্রভাবটিও বুঝতে হবে। পরনির্ভরশীল মানুষেরা কম আত্মপ্রত্যয়ী হয়। অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকায় তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্য ও ব্যক্তিত্ব কম বিকশিত হয়। ফলে আত্মরক্ষার সামর্থ্যও তার কম থাকে। নারীর ক্ষমতায়ন নারীদের আত্মপ্রত্যয়ী বানাবে। ফলে তাদেরকে প্রভাবিত করা ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জন্য কঠিন হবে।
তাছাড়া আপনি হয়তো কল্পনা করছেন, আইন সংশোধন হলেই আপনার বোন সম্পত্তির মালিক হয়ে গেল! এটা মোটেই ঠিক নয়। এটা উত্তরাধিকার, পূর্বাধিকার নয়। আপনি কখন আপনার বাবার সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছেন? নিশ্চয় আপনার বাবা প্রয়াত হওয়ার পর। শিশু বয়সে পিতৃহীন হয়, এমন দুর্ভাগারা ব্যতিক্রম। সবাই সাধারণত নিজে পরিণত বয়সে (৫০–৬০ বছর বয়সে) আসার পর পিতাকে হারান। তারপর আপনি পিতার সম্পত্তির অধিকারী। নারীরাও তেমনি বাল্যকালে সম্পত্তির মালিক হবে না। নিজে ৫০ থেকে ৬০ বছরের প্রৌঢ়া হওয়ার পর পিতৃহারা হলে তারপর একজন নারী সম্পত্তি পাবেন। ঐ বয়সে সম্পত্তি পাওয়ার পর তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন – এমন চিন্তা অবান্তর। আপনি নিশ্চয় বিশ্বাস করেন না, আপনার দাদু মারা যাওয়ার পর আপনার মা পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলে তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন। অপহরণ ও ধর্মান্তরকরণের ঘটনাগুলো সাধারণত ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে ঘটে থাকে। ঐ বয়সে মানুষ উত্তরাধিকার পায় না।
প্রশ্ন: কিন্তু হিন্দু আইন সংশোধন কি এমন জরুরি হল? এখন কি আমাদের মেয়েরা খারাপ আছে?
উত্তর: অবশ্যই হিন্দু নারীরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। সুবিধাভোগীর চোখে বিষয়টি দেখলে হবে না। কিছু কিছু মুসলমান যেমন বলে, “বাংলাদেশে হিন্দুরা জামাই আদরে আছে,” আপনিও সেই ভাষায় হিন্দু নারীদের সম্পর্কে বললে হবে না। প্রথমত, অধিকারহীনতাই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। যার টাকা আছে তার দাম আছে; টাকা নেই, দাম নেই। নারীরা পুরুয়ের উপর নির্ভরশীল ও আশ্রিত হয়ে আছে। যখন ক্রীতদাস প্রথা ছিল, তখনও সবার পরিবারে দাস-দাসীরা খারাপ থাকতো না। ভাল মনিবের বাড়ির দাস-দাসীরা ভাল থাকতো। মনিব খারাপ হলে তারা নির্যাতনে থাকতো। ভাল গেরস্তের গোয়ালে গরু-বাছুরও ভাল থাকে। ভাল মানুষ পশুপ্রাণীকে কষ্ট দেয় না। দাসযুগে বেশিরভাগ দাস-দাসী ভাল মনিবের অধীনে ভাল থাকাটাকে ভাল মনে করে দাস ব্যবস্থাকে ভাল বলার সুযোগ নেই। সে যুগেও সকল দাস-দাসী তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করেনি। বরং অনেকে তৎকালীন মূল্যবোধে বলেছে, “নুন খাই যার, গুণ গাই তার।”
হিন্দু সমাজকে রক্ষার জন্য আইন সংস্কার করে নারীদের পুরুষ-অধিনস্ততা থেকে মুক্ত করা জরুরি। এটা সময়ের দাবি। মনে রাখবেন, রাজা রামমোহন রায় এবং উইলিয়াম কেরিসহ অন্যদের নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করা না গেলে আজকে হিন্দু সমাজে চরম বিপর্যয় নেমে আসতো। আজ যদি মেয়েদের অধিকার না দেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ বিপর্যয়ের শিকার হবে। আজকের শিক্ষিত নারীকে আপনি বঞ্চিত করে আটকে রাখতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে, গার্মেন্টস কর্মী, এনজিও কর্মী, সরকারী চাকুরে, ডাক্তার, প্রোকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষিকাসহ অর্থনৈতিক জীবনের মূলধারায় প্রবেশ করা নারীরা কি কারণে অধিকার বঞ্চিত জীবনধারাকে মেনে নেবে? আজ থেকে ২০০ বছর আগে শিক্ষিত ও কর্মজীবী নারী ছিলনা। পরিবর্তনের বাস্তবতা বুঝতে হবে। সারাপৃথিবীতে নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। শুধু বাংলাদেশের সীমানায় বাস করা হিন্দু-বৌদ্ধ নারীদের অধিকার আটকে রাখবেন– এটা কিভাবে সম্ভব?
“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাধে তারে জীর্ণ লোকাচার।”– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পরিবর্তনই জগতের নিয়ম। যে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনা সে সমাজ জীর্ণশীর্ণ হয়ে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়।
“Whatever retards the onward progress or helps the downward fall is vice; whatever helps in coming up and becoming harmonised is virtue.” অর্থাৎ, যা প্রগতির বিরুদ্ধে তাই পাপ এবং যা প্রগতির সহায়ক তাই ধর্ম’ –স্বামী বিবেকানন্দ
“বাঁচা বাড়ার মর্ম যা,
ঠিকই জেনো ধর্ম্ম তা।”
—ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র।
বাঁচা এবং বাড়া – এই দুই শব্দের মর্ম উপলব্ধি করুন দাদা-দিদিরা। আমাদের প্রগতির পথে এগোতে হবে।