রাজলক্ষ্মীর ধর্মরক্ষা 

অপূর্ব সমদ্দার

রক্ষণশীলতা, শ্রেণিসংঘাত, ধর্মাশ্রয়ী কুপ্রথা, প্রথানুগ্যতা, পুরুষশাসিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রাজলক্ষ্মীদের জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত অগ্নি পরীক্ষা দিয়েই চলেছে। তেমনি বাস্তব কাহিনী এই রাজলক্ষ্মীর (ছদ্ম নাম) জীবনে!!! 

নিজের কষ্ট অন্য কেউ বুঝতে পারে না। বিশেষ করে মেয়েদের বিয়ের পরে বাবার বাড়িতে কোন অধিকার নেই। চাইতে গেলেই সে লোভী। আমার বয়স যখন মাত্র ২ মাস, তখন মায়ের একটা চাকরি হয়। চাকরির শর্ত ছিল যাদের ছোট বাচ্চা আছে বা সন্তানসম্ভবা তারা এখানে এপ্লাই করতে পারবে না। কারন এখানে আড়াই বছরের ট্রেনিং যা হোস্টেলে থেকে নিতে হবে।
মা আমার কথা গোপন রেখেই এপ্লাই করেছিলেন। এবং পরিবারের চাপে আমাকে বাড়িতে রেখেই ট্রেনিং জয়েন করেছিলেন। এদিকে আমাকে চালের গুড়ো, গরুর দুধের সাথে সমপরিমাণ জল এসব খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। অবশ্য মরে গেলেও কারও কিছু এসে যেত না, মা ছাড়া। কারন আমি যে কন্যাসন্তান। অবশ্য পুত্রসন্তান হলে পরিবারের কাছে চাকরি বড় হতো না।
মা যখন ট্রেনিং শেষ করে আসে তখন আমি মাকেই চিনতাম না,কারন তখন আমার বয়স প্রায় তিন বছর। শুনেছি আমাকে কেউ যদি বলতো তোর মাকে ডাক। আমি গিয়ে বলতাম “তোর মাকে” ডাকছে।
এই ঘটনা আমার মাকে সারাজীবন কষ্ট দিলেও পরিবারের আর কারও মনে কোনদিন দাগ কাটেনি। এই কারণে মা যতদিন বেঁচে ছিলেন সবসময় আমাকে একটু বেশি লাই দিতেন। আমাকে কোনদিন বুঝতেই দেননি আমি কন্যা; আমার বাবার বাড়িতে আমার কোন অধিকার নেই।
যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই তখন বাবা বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলছিলেন, মা এতে বাঁধ সাধেন। এরপর ইন্টার পাশ করে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পাই, এতেও বাবা পড়াতে নারাজ। এখানেও মা আমাকে ভর্তি করান।
একসময় ক্লাসমেট এক মুসলিম ছেলে আমাকে তার পছন্দের কথা জানায়। আমি রাজি হই না। কারন ধর্মের দেয়াল। এরপর ও পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়, সিগারেট খাওয়া শুরু করে। আমি ওকে এব্যাপারে বুঝাই, ধর্মের কথা বলি।
ও আমাকে ওল্টা বলে আমার ধর্ম পাল্টাতে হবে না। ও স্টুডেন্ট ভিসায় দেশের বাইরে যাবে। পরে আমাকে নিয়ে যাবে। ওখানে ধর্ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আমরা নিজের ধর্ম বজায় রেখেই সংসার করব, উদাহরণ হিসেবে শাহরুখ খান এর কথা বলে।
এর ২ বছর পর মা আমার আর ওর সম্পর্কে জানতে পারে। প্রায় প্রতিদিন কান্নাকাটি করতো। আমি মাকে বুঝালাম যে আমি ধর্ম পাল্টাবো না। কিন্তু মা মানতে নারাজ। বলে একসময় ধর্ম পাল্টাতে বাধ্য করা হবে।
এভাবে প্রতিদিন মায়ের কান্নাকাটি দেখে আস্তে আস্তে আমার মনে হতে থাকে,মা এত কষ্ট পাচ্ছে। আসলে তো আমার মায়ের কাছে আমি বেশি ঋনী। প্রেম তো দুবছর। আর মা বাবা পরিবার ধর্মের কাছে তো সারাজীবনের ঋন। আমার বিপরীত জন হয়ত আমি চলে গেলে নতুন কাউকে পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে। আমিও নাহয়,ধর্ম,পরিবার, মা এদের জন্য কষ্ট কে বরন করে নিব।
এরপর মা আমার বিয়ে ঠিক করে। এরমধ্যে আমার সে প্রেমিক অনেক কান্নাকাটি করে, আমার হবু স্বামীর ফোন নাম্বার জোগাড় করে তাকে সবকিছুই জানায়।
এখানে বলে রাখা ভালো আমার হবু স্বামী একসময় আমার প্রেমিকের দুলাভাই এর রুমমেট ছিলো। তো এরপর আমার হবু স্বামী আমার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি সব স্বীকার করি এবং বলি ধর্ম রক্ষা করার জন্য আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি, বাকীটা আপনার ইচ্ছে।
এরপর আমারও বিয়ে হয়ে যায় সেও দেশের বাইরে চলে যায়। আমি হয়ে যাই ওর কাছে বেঈমান আর পরিবারের কাছে ভালো, নিজের কাছে মৃত।
বিয়ের ৯ বছর পর আমার মা চাকরি থেকে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্ট এ মারা যায়। এরপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারি মেয়ে মানে বাবার বাড়ির পরিবারে কতটা পর। আমার মায়ের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আমরা ভাইবোনের নামে ছিল। বাবা আমাদের সাইন নিয়ে ঐ টাকা তুলে গ্রামের বাড়িতে দালান বানায়,আগে মাাটির বাড়ি ছিলো।
এখানে বলে রাখি আমার ভাই ঢাকা সেটেল্ড। এরপর বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য নিজের ভাগিনার নামে বাড়ি লিখে দেন। একথা জানায়নি পর্যন্ত। লোকমুখে শুনে বাবাকে প্রশ্ন করলে বাবা স্বীকার করেন। খুব কষ্ট পেয়েছি একথা জেনে যে এখন বাবার বাড়ি আসব না। আসতে হলে পিসিতো ভাইয়ের বাড়ি আসতে হবে।
এই কষ্টের কথা বাবাকে জানাতে গেছি এখন উল্টা শত্রু হয়ে গেলাম। আমি বলতে চেয়েছিলাম বাবার তো ভিটা বাড়ির বাইরে অনেক জায়গা ছিলো। দেওয়ার হলে ওখানে দিত। বাড়ি কেন? নিজের বাবার কাছে ভাগিনা আপন হতে পারে; কিন্তু মেয়ে নয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় কাদের জন্য আমার জন্মের পর থেকে নিজের সব ত্যাগ করলাম?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ