রামকৃষ্ণ মিশন নিয়েও রাজনীতি

গৌতম রায়

ভারতের চলতি লোকসভা নির্বাচনপর্ব (২০২৪) প্রায় শেষ হয়ে আসছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ লোকসভা নির্বাচনপর্ব শেষ হলেই জানতে পারা যাবে ভোটের ফলাফল। ফলাফল যে শাসক বিজেপির অনুকূলে খুব একটা যাবে না, এটা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কথাবার্তা থেকে খুব পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। আর এইরকম একটা পরিস্থিতিতে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি আর তাদের স্বাভাবিক মিত্র, প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি, তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে বাইনারি দিকটি ভীষণভাবে প্রকাশ্যে চলে এসেছে।

রামকৃষ্ণ মিশনের জলপাইগুড়ি শাখায় সম্প্রতি দুষ্কৃতকারীরা ন্যক্কারজনক আক্রমণ চালিয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন এমন একটি সংগঠন যারা কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতার পরিমণ্ডলে নিজেদের আবদ্ধ রাখে না। আধ্যাত্মিক কর্মকা-ের পাশাপাশি শিক্ষা এবং সমাজসেবার ক্ষেত্রে এই সংগঠনটি কোনোরকম জাতপাত ধর্মের সংকীর্ণতার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ না করে, যেভাবে মানুষের সেবায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আত্মনিবেদিত, তা যেমন সাধারণ মানুষের কাছে পরম আদরনীয়, আবার সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন, দল-মতের লোকেদের কাছেও বিশেষ শ্রদ্ধা সম্মানের জায়গা তৈরি করেছে।

রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরের দুর্নীতি এখন একটা এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে দলের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে একেবারে ভূমিস্তরের কর্মী; কারোর ওপরই আর মুখ্যমন্ত্রীর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ নেই। চাকরি দেওয়ার নাম করে, সাধারণ মানুষের থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করবার মতোই, মানুষের জমি দখল করা একটা জ্বর সর্দি কাশির মতো সাধারণ ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

এ ধরনের অসুখ মানুষের শরীরে হলে প্রথমেই যদি তাকে নিরাময় না করা হয়, তবে সেই অসুখ যে একদিন প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এটা সাধারণ মানুষ জানলেও, বুঝলেও, রাজ্য সরকারের আর এসব জেনে বুঝে, সত্যি কিছু করবার মতো উপায় নেই। যাদের বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটবেন, তারা প্রত্যেকেই তাদের দুর্নীতির বখরা, স্বজনপোষণের বখরা, জমি দখলের বখরা, কিভাবে খোদ কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে এসে, রাজনৈতিকভাবে সামাজিকভাবে মমতাকে আরও বেকায়দায় ফেলবেন।

রামকৃষ্ণ মিশনের জলপাইগুড়ি শাখায় দুষ্কৃতদের ভয়াবহ হামলার পর রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে কেবল গা ঢিলে দেওয়ার ব্যাপারই ঘটছে না। খোদ মুখ্যমন্ত্রী, যিনি কিনা পুলিশ মন্ত্রীও, তিনি প্রকাশ্যে বলছেন ঘটনার বেশ কিছু সময় পরে, ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না। রামকৃষ্ণ মিশন কোনো পাড়ার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নয়। জাতীয় স্তরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও রামকৃষ্ণ মিশনের একটি বিশেষ মর্যাদা, সম্মান রয়েছে।

পুলিশ ঘটনাটি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীকে ওয়াকিবহাল করেনি এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করার এক ঘন্টার মধ্যেই রামকৃষ্ণ মিশনের দুজন প্রবীণ সন্ন্যাসীর নামে, জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হলো। যে দুজনের নামে অভিযোগ দায়ের করা হলো, তাদের মধ্যে একজন ঘটনার সময়কালে সুদূর উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে মুঠিগঞ্জ এলাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের যে শাখা কেন্দ্রটি আছে, তার দায়িত্বে কর্মরত রয়েছেন। দুষ্কৃতরা যখন জলপাইগুড়িতে মিশনের শাখা কেন্দ্রে হামলা চালায় সংশ্লিষ্ট সাধুটি তখন প্রয়াগ রাজি অবস্থান করছেন।

এই যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বত্যাগী দুজন সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হলো, খুব অবাক লাগে, সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন প্রশাসক হিসেবে যে রাজ ধর্ম পালন করা দরকার ছিল মমতার, সে পরিচয় আমরা তার কাছ থেকে পেলাম না।

অপরপক্ষে মমতার এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অবস্থান রামকৃষ্ণ মিশনকে ঘিরে, স্বভাবসুলভভাবেই এ ঘটনাকে রাজনৈতিক পুঁজি করে ভোট কুড়োতে নেমে পড়ল বিজেপি। আড়ালে চলে গেল রামকৃষ্ণ মিশনের ওপর হামলার ঘটনাটি। আড়ালে চলে গেল রামকৃষ্ণ মিশনের দুজন প্রবীণ সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে দায়ের করা জামিন অযোগ্য ধারায় এফআইআরের প্রসঙ্গটি।

বিজেপি যদি প্রকৃতই রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরাগী হতো, তাহলে রামকৃষ্ণ মিশনের এই দুজন প্রবীণ সন্ন্যাসীর উপর যে আইনি হেনস্থার কর্মকা- চলছে, সেখান থেকে তাদের বের করে আনবার ক্ষেত্রে রাজনীতি ব্যতিরেকে, প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করত। তা না করে তারা মমতা কতটা হিন্দুবিরোধী; বলা বাহুল্য এই প্রচারের উপক্রমের মধ্যে দিয়ে বিজেপি বোঝাতে চাইলো। মমতা কতখানি মুসলমানপ্রেমী সেটা প্রমাণ করতে যেন একটা গাজোয়ারির জায়গায় চলে গেল ভারতের শাসক দল বিজেপি।

মমতার রামকৃষ্ণ মিশনকে রাজনৈতিক তকমা দেওয়া ঘিরে যেমন রামকৃষ্ণ মিশনের শিষ্য, অনুরাগী, ভক্ত- প্রত্যেকটি মহলই ক্ষুব্ধ। ঠিক তেমনই যারা আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষিতে রামকৃষ্ণ মিশনকে ঘিরে খুব একটা উৎসাহী নন, কিন্তু মিশন পরিচালিত বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা প্রাক্তনী, যাদের নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে একটা আবেগ আছে, সেই অংশের মানুষ এবং তাদের পরিবার পরিজন, মিশনকে ঘিরে মমতার মূল্যায়ন নিয়ে প্রচন্ড রকম ক্ষুব্ধ। ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ঘিরে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা না থাকলেও, রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষার প্রসারে অনবদ্য অবদান, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের অক্লান্ত সেবা, তাছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধী, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের আর্থ-সামাজিক পুনর্বাসন এবং স্বাবলম্বনতা অর্জনের জন্য তাদের যে সমস্ত কর্মকা-, এগুলো সব ধরনের মানুষকে মুগ্ধ করে।

যদি কোনো মুসলমান শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারার প্রতি অনুরাগী হন, তার সমন্বয়ী চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তবে তিনি তার নিজের জন্মসূত্রে অর্জিত ধর্ম বজায় রেখেই মিশনের কর্মধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তার নিজস্ব ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে মিশন কখনো, কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করে না।

এসব দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে ধার্মিক, ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক- সব অংশের মানুষের কাছে রামকৃষ্ণ মিশনের যে গ্রহণযোগ্যতা, সেটা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি পছন্দ করে না। অথচ রামকৃষ্ণ মিশনকে ব্যবহার করবার চেষ্টা তারা করে। যদিও কোনো অবস্থাতেই সাফল্য লাভ করতে পারে না তারা। এই রকম একটা অবস্থায়, বিজেপির পক্ষে ধর্মান্ধ হিন্দু ভোট ধর্মপ্রাণ হিন্দু ভোট, ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু ভোট- সমস্ত কিছুকে একত্রিত করবার জন্য মমতাই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি অসম্মান, অমর্যাদা সূচক, অসত্য কথাগুলো বললেন।

রামকৃষ্ণ মিশনের মতো একটি সংগঠনের সাধুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে, তাতে জামিন অযোগ্যধারা আরোপ করার আগে পুলিশ কেন কোনরকম তদন্ত করবে না? পুলিশ কি জানবার চেষ্টা করবে না অভিযোগটি সত্যতা ঘিরে? মিশনে সাধুদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় অভিযোগ দায়ের করছে সেই অভিযোগগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে যে ধারাগুলো পুলিশ মিশনে সাধুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছে, সেটি তো যারা অভিযোগ করছেন তারা করেনি। আইনগতভাবে এটা তাদের করবার কাজ নয়। এটা করেছে পুলিশ। কেন ধারাগুলি প্রয়োগের আগে ঘটনার যথার্থতা প্রাথমিকভাবে যাচাই না করে, এভাবে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারা লাগু করল?

পশ্চিমবঙ্গে চলতি লোকসভা ভোটের গতিপ্রকৃতি যেদিকে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়ই প্রচন্ড রকমের কোণঠাসা অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বাম-কংগ্রেস জোট যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে রুটি রুজির প্রশ্ন, কর্মসংস্থানের প্রশ্ন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রশ্ন এবং অবশ্যই মোদি-মমতার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তুলে ধরছে, তার দরুন মানুষের মধ্যে সচেতনতা আরো জোরদার হয়েছে। মহম্মদ সেলিমের সিপিআইর (এম) নেতৃত্ব দেওয়ার পর যে সাহস, লড়াকু মানুষিকতা কেবলমাত্র বামপন্থি দলগুলো নেতাকর্মীদের মধ্যেই নয়, সমস্ত স্তরের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের মানুষের মধ্যে নতুন করে সঞ্চারিত হয়েছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে মোদি-মমতার সমস্ত রকমের রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ ওলট-পালট করে দিচ্ছে। বাম-কংগ্রেস জোটের রাজনৈতিক সাফল্য আটকাবার উদ্দেশ্যেই রামকৃষ্ণ মিশনকে জনসমক্ষে অমর্যাদার শরিক করে বিজেপির ভোট বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মমতার এই সাম্প্রদায়িক বাইনারি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

কৃতজ্ঞতা:।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট।।সোর্স লিংক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ