সবার ওপরে মানুষ

নাসরীন মুস্তাফা

কত কিছুই না ভাইরাল হয় আজকাল- ভাইরাল হওয়া উচিত এমন একটি খবর পড়ে যারপরনাই তৃপ্তি পেলাম। আরেকবার অনুভব করলাম ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যার সমাধান করা খুব সহজ। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী সবার অভিমত এক- মহান সৃষ্টিকর্তা সবকিছুকে, সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। প্রাচীন পৃথিবীতে রাজত্ব করা বিশালাকৃতির ডাইনোসরদের যেমন সৃষ্টি করেছিলেন, এককোষী অ্যামিবা সৃষ্টিও তাঁর কাজ। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারা ভাইরাসও। সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব বর্ণের মানুষ তো তাঁরই সৃষ্টি। এই বিশ্বাসী মানুষের কেউ কেউ আবার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট অন্য মানুষকে লক্ষ্য করে ঘৃণা ছড়ায়। সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট কাউকে ভালোবাসেন- এটা ভেবে মিথ্যে ঢেঁকুর তোলার কোনো উপায় নেই। কাজের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, এটা সব ধর্মের মোদ্দাকথা। কাজটা তবে কি? সৃষ্টিকর্তা খুশি হবেন তেমন কাজ-ই তো কাজ। তাঁকে খুশি করতে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসা, তাদের উপকারে আসা নিশ্চয়ই সত্যিকারের কাজ। অথচ পৃথিবীজুড়ে কেবলই হানাহানি-দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। উন্মাদের মতো আমরা একে আটকাতে চাই, ওর ওপরে ঘৃণা উগরে দিতে চাই, তাকে নিশ্চিহ্ন করতে কূটকৌশল করি। কেন এমন করছি আমরা? কেন ধরে নিচ্ছি আমিই শ্রেষ্ঠ। আমার কথাই সর্বশক্তিমান শুনছেন? আমি যার ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাচ্ছি তার করুণ আকুতি কি তিনি শুনতে পাচ্ছেন না? যে যেভাবে পারছে শক্তি দেখাচ্ছে। দাগের ওপাশে দাঁড়ানো শক্তিহীন কখনো পাল্টা শক্তি দেখাবে কি না ভেবে দেখছি তো?

দাগের এপাশে দাঁড়ানো পুরুষ আর নারী -এই আমরা ভুলে যাই দাগের ওপাশে দাঁড়ানো আরও মানুষ আছে, যারা পুরুষ আর নারীর মাঝামাঝিতে আটকেপড়া মানুষ। হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে যাদের না জেনে না বুঝে আলাদা করতে চাই তারাও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কেবল পুরুষ আর কেবল নারী হতে হবে আমাদের বানানো এই নিয়ম সৃষ্টিকর্তা মানেননি বলেই তো সমান ভালোবাসা দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন এই মানুষদেরও। অথচ আমরা তাদের মানুষ বলেই স্বীকার করতে চাই না। মানুষের অধিকার কেবল আমরাই ভোগ করব, হিজড়ারা কেবলই নিগৃহীত হবে লিঙ্গের ‘দোষে’- যার জন্য বিন্দুমাত্র দায় তাদের নেই। হিজড়া শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহার করে তাদের নিগৃহীত করছি। অথচ জানি না হিজড়া শব্দের মানে কী। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান মতে ‘হিজড়া’ শব্দটি এসেছে হিন্দি ভাষা থেকে। যদিও হিজড়া বিষয়ক গবেষকদের মতে শব্দটি আসলে ফারসি। এর অর্থ ‘সম্মানিত ব্যক্তি’।

ইসলাম ধর্মে হিজড়াদের স্বভাব অনুযায়ী নারী এবং পুরুষে ভাগ করে অন্য নারী-পুরুষের মতো স্বাভাবিকভাবে সব সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তা হয়নি। হিজড়া শিশুকে স্কুলে ভর্তি করা হচ্ছে না, বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে হিজড়া বাচ্চাদের খেলতে দেন না। সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত দেওয়া হয় না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাজ পান না। হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে সমস্যা। সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ভাই-বোন। হিজড়া পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাওয়ায় সমাজের কাছে অপদস্থ হওয়ার ভয়ে তাদের ত্যাগ করে বাবা-মা।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী এবং পুরুষের বাইরে মানুষের যে ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয় আছে সরকারিভাবে এর স্বীকৃতি এসেছে। হিজড়াদের জন্য অনেক চাকরিতে বিশেষ কোটা রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় নানাভাবে সরকারি ভাতা, বিশেষ প্রণোদনা পাচ্ছেন তারা। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় হিজড়ারা জমিসহ ঘর পেয়েছেন। এখন স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের চার স্তরে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর) উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। যাদের বয়স ৫০-এর বেশি এমন অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের মাসিকহারে বিশেষ ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তাদের দক্ষতা বাড়াতে নানারকমের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ আছে এখন। এরপরও হিজড়াদের কেন মানুষের অধিকার পেতে যুদ্ধ করতে হয়? অসম্মানের জীবনের ঘানি টেনে মৃত্যু হলেও অবসান ঘটে না বঞ্চনার। মৃত মানুষের সৎকার করা জীবিত মানুষের কাছে মৃত মানুষের চাওয়া শেষ সম্মানটুকুও জোটে না এই মানুষদের কপালে। হিজড়া বলে জানাজা পড়াতে রাজি না হওয়া, কবর দিতে বাধা দেওয়ার নানা ঘটনা উঠে আসে পত্রিকার পাতায়।

এবার পত্রিকার পাতায় উঠে আসা খবরটির কথা বলি, যা ভাইরাল হওয়া উচিত এবং ভাইরাল করতে চাই বলেই লেখাটি লিখছি। ময়মনসিংহ শহরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ চর কালিবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া ৪০ জন হিজড়া এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে নানা বাধার সম্মুখীন হতেন। নিজেদের জন্য একটি মসজিদ তৈরির কথা ভাবেন তারা। ভাবনাকে কাজেও পরিণত করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে মসজিদ। ভালো লেগেছে জেনে যে, এই মসজিদে হিজড়াদের সঙ্গে নামাজে শামিল হচ্ছেন এলাকার মুসল্লিরাও। অর্থাৎ ইসলামের মহান আদর্শ ‘সব মানুষ সমান’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করলেন এখানকার মানুষ। যারা সমালোচনা করেছেন বা করছেন আশা করি অচিরেই তারা সভ্য মানুষের মতো ভাবতে শুরু করবেন। হিজড়া জনগোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে এই মসজিদে তার গোসল ও জানাজা হবে এ সত্যই স্বস্তিদায়ক ভাবনা।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয় দেখিয়ে হিজড়াদের অধিকারবঞ্চিত করার চেষ্টা সমাজের শক্তিশালী অংশের পেশিশক্তি দেখিয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। এজন্যই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও নানা সহায়তামূলক কার্যক্রমের পরও হিজড়াদের এখনো সমাজের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। যে যেখানে, যেভাবে জন্ম নিক না কেন মানুষের অধিকার সবাই সমানভাবে পাবে- এই দাবি কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সামনে আরও হবে। মানুষের সভ্যতা নেতিবাচক ভাবনা আর দখলদারিত্বের উদগ্র আকাক্সক্ষা থেকে বেরিয়ে ইতিবাচক পথে চলতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট।।সোর্স লিংক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ