ছোটন সুশীল
সবাই পারে না, শুধু কেউ কেউ পারে -ব্লগার কবি সুনীল সমুদ্রর এই একটা লাইন অনেক কিছুই বুঝিয়ে দেয়। হাজার বছর ধরে চলে আসা কোন ধর্মীয় কুসংস্কার, প্রথা বা সামাজিক বিধি বিধান এর সংস্কার কিংবা আধুনিকরণ এর চিন্তা করা ও সেই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে চাওয়ার চেষ্টা করা মহাসাগর সাঁতরিয়ে পার হওয়ার মতোই দুঃসাহসের। যখন অনেকের পক্ষে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না বৈষম্য জেনেও যার যার সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে, কিংবা যখন কেউ কেউ এতদিন কেউতো করেনি আমি কেন করবো এই মানসিকতা নিয়ে অন্যায়কে নীরবে মেনে নেয়, তখন কেউ কেউ অসম্ভব জেনেও বুক চিতিয়ে বীরের মতো লড়ে যায় ন্যায় প্রতিষ্টায়। দুজন মানুষের মধ্যে ব্যবধান এখানেই। সমাজ এর স্রোতের বিপরীতে এই ন্যায় লড়াইয়ের চিন্তা কিংবা দুঃসাহস খুব গুটি কয়েক মানুষ ই করতে পারে। অন্যরা পারে না তাদের নিজেদের স্বার্থে আঘাতের ভয়ে, প্রভাব প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে। রাজা রাম মোহন রায় কিংবা বিদ্যাসাগর এর সমসাময়িক সময়ে অনেক গুণী পন্ডিত ব্যক্তিরা ও যেখানে এই প্রথাগুলো ভাঙার সাহস করেনি সেই সময়ে এই দুজন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তাদের লক্ষ্য সফল করেছেন তাদের জ্ঞান, সৎ সাহস আর মানসিক দৃঢ়তার উপর নির্ভর করে। প্রভাবশালী ও সংখ্যাগরিষ্ট হয়েও অমানবিক অন্যায় কুপ্রথা, কুসংস্কার কে প্রশ্রয় দেয়ায় শেষ পর্যন্ত মাথা নুয়াতে বাধ্য হয়েছে তখনকার বড় বড় হিন্দু পন্ডিত ও সমাজপতিরা।
শত শত বছর ধরেই বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের উপর যে বৈষম্য, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কন্যাকে ভাগ ই না দেয়া, বিধবা স্ত্রীকে জীবনিস্বত্ব নামক শেকলে আটকে রাখা, পরিবারের সদস্য হয়েও জন্মান্ধ, বোবা কিংবা পরিবারের কোনো সন্তান তৃতীয় লিঙ্গের হলে তাদের কে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা, শুধুমাত্র পুরুষ বলেই স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া ইচ্ছে করলে যত খুশি বিয়ে করার উৎসাহ পাওয়া, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক না করে স্ত্রীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখাসহ আরো অনেক বৈষম্য বুকে চেপে দেবী নামের স্বান্তনা নিয়ে মুখ বুঝে সহ্য করে হিন্দু নারীরা যখন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, তখন ওদের এই বৈষম্যের প্রতিবাদ কিংবা কিভাবে এই বৈষম্য বিলুপ্ত করে মা, স্ত্রী বোন কন্যাদের মুক্তি দেয়া যায় সেটা নিয়ে কোনো হিন্দু ধর্মীয় গুরু, নেতা কিংবা কোনো সংঘটনের দৃষ্টিই নাই। মেয়েরা তো মেয়েই, মানুষ তো না যেন এই ভাব পুরুষ শাসিত হিন্দু সমাজের।
যে সময়ে গজিয়ে উঠা শত শত হিন্দু সংঘটন, হাজার হাজার নেতা নিজের ঘরের মা দূর্গা কে বঞ্চিত রেখে বড় বড় পেন্ডেলে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক লাইটিং এ মাটির দুর্গার বন্দনায় মত্ত, যারা চিন্তাই করতে পারেনি হিন্দু আইন সংস্কার ও নারীর অধিকার এর বিষয়ে যার যার পদ পদবি প্রভাব হারানোর ভয়ে, সেখানে গুটি কয়েক উন্নত চিন্তার মানুষ অনেকটা দুঃসাহস করেই স্রোতের বিপরীতে সাঁতরিয়ে মহাসাগর পাড়ি দেয়ার মতো নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ শুরু করে। এই যে কেউ কেউ পারে এদের দলেই এই সব সাহসী সংস্কারপন্হীরা। বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ এর নেতৃত্বে যে সব দুঃসাহসিক গুণীজনরা আছে কিংবা যে সব সহ যোদ্ধারা সারা দেশে সমর্থন জোগাচ্ছেন মায়েদের বোনেদের কন্যার স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে, তাদের সাহস চিন্তা ভাবনা মানসিকতা কে আমার পক্ষ থেকে জানাই স্যালুট আর শ্রদ্ধা। বিশেষ করে যেসব নারীরা পরিবার সমাজের শৃঙ্খলে বাধা থেকেও সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, অপমানসূচক তির্যক বাক্যবানে বিদ্ধ হয়েও এই সাহস দেখাচ্ছেন সেই সব দিদিরা আরো বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কারণ আমি মনে করি এসব চিন্তা করার সাহস কিংবা মানসিকতা সবার পক্ষে দেখানো সম্ভব হয় না কিংবা সাহস থাকলেও পরিবার সমাজের বাধার কারণে সেটা প্রকাশ করাও সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি ডক্টর ময়না তালুকদার ম্যাডামসহ শীর্ষ সব নেতৃত্বকে এবং সকল সহযোদ্ধাদের সম্মানপূর্বক একজনের কথা না বললেই নয়, শত বিদ্রোপ, উপহাস, গালি হুমকি উপেক্ষা করেও রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর এর মতো স্রোতের বিপরীতে যিনি বুক চিতিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্টায় লড়ে যাচ্ছেন তিনি সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী পুলক ঘটক দাদা। স্রোতের বিপরীতে সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের, অবহেলিত বঞ্চিত হিন্দু মা বোন কন্যার পাশে দাঁড়ানোর মতো এরকম দুঃসাহসী লোক সবাই হয় না সবাই হতেও পারে না। কেউ কেউ পারার মধ্যে সাংবাদিক পুলক ঘটক একজন।
তাই যারাই হিন্দু সমাজের শিক্ষিত, সচেতন মানুষ সব জেনেও কি দরকার এসবের বলে চুপ করে আছেন বা যারা এই ব্রিটিশ প্রণীত হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার এর বিরোধিতা করছেন, আপোষ করছেন অন্যায়ের সাথে, নিজেদের পরিচিতি পদ পদবি হারানোর ভয়ে, যদি একটু মানবিকতা থাকে মায়ের প্রতি, বোনের প্রতি, কন্যার প্রতি, আপনারা ও এবার সমাজের অর্ধেক শক্তি নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলুন। আদিম যুগের চিন্তা বাদ দিয়ে উন্নত বিশ্বের মতো নারী পুরুষ এক সাথে মিলে সমাজ রাষ্ট্র কে এগিয়ে নেয়ার চিন্তা করুন। আপনার একটু সচেতনতা, একটু সহমর্মিতা নিরাপদ করতে পারে আপনার মায়ের, কন্যার, বোনের, স্ত্রীর সুন্দর ভবিষ্যৎ, একটি সুন্দর হিন্দু সমাজ। তাই একটু অন্য ভাবে চিন্তা করুন, দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক করুন, সবাই না পারলেও কেউ কেউ যে পারে ওদের মতোই একটু চেষ্টা করুন। আপনার আমার সবার একটু একটু চেষ্টায় হিন্দু সমাজের লিঙ্গ, বর্ণ বৈষম্য দূর হতে বাধ্য।
বি। দ্র। -কিছু কিছু লোক বলবে ব্যক্তি চর্চা বা ব্যক্তি প্রশংসা ভালো না। আমি ও মানি কিন্তু সমসাময়িক বাস্তবতায় কিছু মানুষের দুঃসাহস কে সম্মান জানানো যদি ব্যক্তি প্রশংসা বলে ধরে নেন, সেক্ষেত্রে ব্যক্তিচর্চা করতে আমার আপত্তি নেই, কারণ সবাই সব কিছু পারে না কেউ কেউ পারে। তাদের সম্মান সাহস যুগানো ও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার হোক।
মা বোন কন্যা স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিরাপদ হোক।