ছোটন সুশীল
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বিদ্রোহী কবি হিসাবে বেশি পরিচিত হলেও একই সাথে সাম্যের কবি, প্রেমের কবি, নারীবাদী কবি হিসাবেও কবিকে পরিচিত করা যায়। নারী পুরুষের সমঅধিকার, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে কবি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। কবি নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কবি মনে করতেন নারীর সাহস, অনুপ্রেরণা ছাড়া পুরুষরা এতটা সাফল্য পেত না। তাই কবি সাম্যের গানই গেয়েছেন যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনো স্বীকৃতি দিতে চায় না।
তাই নজরুল ‘নারী’ কবিতায় ঘোষণা করলেন :
‘‘সাম্যের গান গাই,
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই,
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ – তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। ”
(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪১)
কবি শুধু সমঅধিকার নয়, অবহেলিত নারীর সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, জীবনযাপন এ পুরুষতান্ত্রিকতার যে প্রভাব সেটা ছিন্ন করার জন্য যেমন নারীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে তেমনি শৃঙ্খলিত বন্ধন ভেঙে নিজেদের মুক্ত করতে না চাওয়ার দ্বায় ও চাপিয়েছেন নারীদের উপর। তিনি মনে করতেন –
যারা শৃঙ্খলিত হয় তাদের মধ্যেই যদি শৃঙ্খল ছিড়ে মুক্ত হওয়ার মানসিকতা না জাগে তাহলে মুক্ত হওয়া অসম্ভব। কবি মনে করতেন এই সমাজে কেউ কাউকে অধিকার দেয় না, অধিকার কেড়ে নিতে হয় নিজেদের যোগ্য করে শিক্ষায়, জ্ঞানে, নেতৃত্বে। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় নারী শিক্ষা ছিল অনেকটা দুরূহ। নিজে খুব বেশি প্রাতিষ্টানিকভাবে শিক্ষিত না হলেও উনি বুঝতেন শিক্ষার গুরুত্ব। শুধু পুরুষ নয় নারীদের নিজেদের মুক্ত করতে, শৃঙ্খল ভাঙতে যে শিক্ষার প্রয়োজন এই বোধ থেকেই কবি লিখেছেন –
‘‘কন্যাকে পুত্রের মতই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা জায়া জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই র্সবপ্রথমে বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কীসে দুঃখ কীসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে। ” (তরুনের সাধনা, নজরুল রচনাবলী, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৯৬)
নারীরা মুক্ত হবে, বিজয় পতাকা উড়াবে এই স্বপ্ন কবি সব সময় দেখতেন। কিন্তু এটাও জানতেন পুরুষ কখনো কোনো নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে চায় নি, চাইবে না জয়ের অংশীদারিত্বের ভাগিদার করতে। সব সময় রচিত হয় পুরুষের বিজয়ের ইতিহাস, নারীরা হয় বঞ্চিত, তাই কবি বলেছেন —
‘‘জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?”
(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ: ২৪২)
পুরুষ সমাজ যেভাবে নারীর চরিত্রকে কলুষিত করতো সেটার ও তীব্র প্রতিবাদ কবি করেছে তার লেখায়। সব দোষ নারীর, পুরুষ রা শুধুই সাধু, কলঙ্কমুক্ত। এই প্রতিবাদে নারীর পক্ষেই কবির প্রতিবাদ ছিল –
অসতী মাতার পুত্র সে যদি তবে, জারজ পুত্র হয়
অসৎ পিতার সন্তান ও তবে, জারজ সুনিশ্চয়।
এমন সাহসী উচ্চারণ আজ একশো বছর পরে এসেও নারীদের সাহস যোগাবে নিশ্চয়ই।
সকল পর্যায়ে পুরুষের পাশে, হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে। সময় এসেছে এখন নারীদের জেগে উঠার, নারীদের অধিকার, পুরুষদের থেকে বুঝে নেয়ার, ছিনিয়ে নেয়ার।
আমাদের দেশে যে সব নারীরা বঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত এদের সাথে নিয়ে,
সব হিন্দু নারীদের যারা সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত জেগে উঠতে হবে তাদেরই যার যার মতো করে যার যার অবস্থান থেকে। কারণ সময় পাল্টেছে, আর কত মুখ বুঝে থাকবেন ? জীবন্ত লাশ হয়ে আর কত রাত কাটাবেন ভোরের আশায় !! দয়ায় নয় অধিকার নিয়েই বাঁচুন
মহান কবির মতো বলে উঠুন –
“সে যুগ হয়েছে বাসি
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো,
নারীরা ছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবেনা বন্দী কাহার ও, উঠিছে ডন্কা বাজি।”
কবি নজরুল নারীদের আগুন হয়ে জ্বলে উঠার আহবান করেছেন। যে আগুন আমাদের আধুনিক সভ্যতার সূচনা করেছে, যে আগুন আমাদের আলোকিত করেছে সে আগুন যেন নারীরা নিজেদের বুকে ধারণ করে, তাই কবি নারীদের স্বাহা হিসাবেই জ্বলে উঠতে আহবান জানিয়েছেন। কবি বলেছেন –
জাগো নারী জাগো, জাগো বহ্নিশিখা /জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত টিকা।
এই স্বাহা অগ্নির স্ত্রীবাচক শব্দ হিসাবেই কবি ব্যবহার করেছেন নারীদের জাগরণের প্রত্যয়ে।
আমাদের বর্তমান হিন্দু সমাজে যে সব মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, নানা বৈষম্যের শিকার, কবির মতোই বলি আগুন হয়ে জ্বলে উঠুন একবার, নিজেদের অধিকার কে নিজেরাই কেড়ে নিন, পুরুষতান্ত্রিক অমানবিক হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার এর মাধ্যমে।
আপনাদের জাগরণে সমাজ শোষণহীন হতে বাধ্য হবে, বদলাতে বাধ্য হবে পুরুস্ত্রান্ত্রিকতা।
নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাক, নারীরা ও জেগে উঠুক কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে কবির ১২৫তম জন্মদিবসে কবিকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
জয় হোক মানবতার, জেগে উঠুক নারীশক্তি, অন্ধকারমুক্ত, কুসংস্কারমুক্ত হোক হিন্দু সমাজ।
হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার হোক।
শুভ জন্মদিন হে মহান কবি
লেখক: সমাজকর্মী