দুইশত বছরের স্বাক্ষী, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মজিদপুর জমিদার বাড়ি

কুমিল্লার তিতাস উপজেলার দুইশত বছরের পুরনো মজিদপুর জমিদার বাড়ি অযত্ন, অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির অধিকাংশ স্থাপনা এখন বিলীনের পথে। সংস্কার করলে ভ্রমণপিপাসুর ভিড় বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা।

কুমিল্লা থেকে ৫০ কিলোমিটার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গৌরীপুর বাস ষ্টেশন থেকে উত্তর দিকে হোমনা-গৌরীপুর সড়কের ১০ কিলোমিটার উত্তরে তিতাস উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন অবস্থিত। কমপ্লেক্স ভবন সংলগ্ন কড়িকান্দি (চালানচাপুর) বাজার থেকে ঠিক পশ্চিম দিকে ৫ কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়বে কালের সাক্ষী মজিদপুর জমিদার বাড়ি।

জমিদার বাড়ি মানেই অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবন। দেয়ালের প্রতিটি পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া, ইতিহাস ও ঐতিহ্যর সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। অন্যান্য জমিদার বাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মজিদপুর জমিদার বাড়িতে। এখানে পাশাপাশি কয়েকটি ভবন রয়েছে। প্রতিটি ভবনই চমৎকার কারুকার্যমণ্ডিত।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহত্তর দাউদকান্দি মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হলেও সোনারগাঁয়ের হিন্দু জমিদারদের অধীনেই পরিচালিত হতো দাউদকান্দি পরগণা। তিতাসের মজিদপুরে হিন্দু জমিদার বাড়ির নিদর্শন এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

এই বাড়িতে মোট ১৭ টি ভবন ছিল। তার মধ্যে ৪টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে৷ এছাড়া, জমিদার বাড়ির আশেপাশে ১টি দীঘি এবং ছোট বড় মিলে ২০টি পুকুর খনন কর হয়েছিল। দীর্ঘদিন যাবৎই জমিদারদের প্রাসাদপম ভবন সমুহ মুসলমানদের দখলে রয়েছে। বর্তমানে তাদের কোন উত্তরাধিকারীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় অবস্থিত দুইশত বছরের পুরনো মজিদপুর জমিদার বাড়ি।

পাকিস্থান সৃষ্টির পরই হিন্দু জমিদাররা তাদের সবকিছু পরিহার করে ভারতে চলে যান। বর্তমানে সবগুলো ভবনই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে ভবনগুলো বেশ কারুকার্য খচিত এবং বিভিন্ন খুপড়ির অস্তিত খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনগুলোর মাঝে সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে।

জমিদারী শাসনের শুরুর দিকে মজিদপুর জমিদার বাড়ির প্রথম পুরুষ শ্রী রামলোচন রায় মজিদপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। মেঘনা, তিতাস, হোমনা ও মুরাদনগর পর্যন্ত তাদের জমিদারী ছিল। জানা যায়, প্রায় ১৮ শতকের দিকে শ্রী রামলোচন রায় বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রী রামলোচন রায়ের তিন পুত্র শ্রী কালীচরন রায়, ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এবং শিবচরন রায়।

জমিদারী আইন বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত বংশ পরস্পরায় তাদের জমিদারী চলে। শ্রী কালীচরনের পাঁচ ছেলে যথাক্রমে পিয়ারী মোহন রায়, বিহারী মোহন রায়, শশী মোহন রায়, শরৎচন্দ্র রায় এবং মোহিনী মোহন রায়।

ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এর তিন ছেলেরা হলেন ক্ষিতিষ চন্দ্র রায় যিনি মজিদপুর ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, গিরিশ চন্দ্র রায় এবং শিরিশ চন্দ্র রায়। শিবচরন রায়ের দুই ছেলে হলেন হররাল রায় এবং যোগেশ চন্দ্র রায়। শিরিশ চন্দ্র রায় গর্ভবতী স্ত্রীকে হত্যা করে উম্মাদ হয়ে যান। তাকে জমিদার বাড়ির একটি প্রকোষ্টে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো।

এ অবস্থাই তার মৃত্যু হয়। ক্ষিতিশ চন্দ্র রায়ের দুই পুত্র শ্রী নারায়ন চন্দ্র রায় এবং শ্রী দুর্গাচরন রায়। শ্রী দুর্গাচরন রায়ের তিন পুত্রের মধ্যে ক্ষেত্র মোহন রায় তিতাস উপজেলার প্রথম এন্ট্রাস পাশ, প্রথম গ্রাজুয়েট এবং প্রথম আইনজীবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। অপর ছেলে কুঞ্জ মোহন রায় মজিদপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। শরৎ চন্দ্র রায়ের ছেলে উপেন্দ্র চন্দ্র রায় তিতাস উপজেলার প্রথম গ্রাজুয়েট ডাক্তার।

রামলোচন ছাড়াও তাদের বংশের আরও যারা জমিদারী করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাম সুন্দর রায় এবং রামগতি রায়। এদের মধ্যে রামগতি রায়ের পুত্র নলিনী ভূষণ রায় মজিদপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

কথিত আছে, জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের উপর নানাহ অত্যাচার ও জোর জুলুমের কথা। খাজনা, লগ্নি ও মহাজনী সুদের টাকা সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে বন্ধকী সম্পত্তি জবর দখল করে নিত এবং নির্যাতন চালাত। মুসলমানরা তাদের বাড়ির নিকট দিয়ে জুতা পায়ে এবং ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারতো না।

তিতাসের মজিদপুর জমিদার বাড়িতে গেলে খানিকটা সময়ের জন্য আপনি চলে যেতে পারেন অতীতে। হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠবে, কানে ভেসে আসবে জমিদার বাড়ীর আগের কোলাহল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা ভালো হয়ে যাবে। তবে সেই সঙ্গে একটু দুঃখবোধও মনের কোণে উঁকি দেবে। কারণ অবহেলায় আর অযন্তে জমিদার বাড়িটি ঐতিহ্য ক্রমেই ম্লান হতে চলেছে।

।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট।।সোর্স লিংক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ