‘নারীর সামাজিক উত্তরণ চেয়েছিলেন নূরজাহান মুরশিদ’

কালবেলা: রাজনীতিবিদ ও আন্দোলনকর্মী নূরজাহান মুরশিদ নারীর সামাজিক উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। আমৃত্যু তিনি জনসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে যে নারীরা সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য ছিলেন।

বুধবার (২২ মে) রাজধানীর বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে নূরজাহান মুরশিদ স্মারক বক্তৃতা ‘মুর্শিদাবাদ অনুষঙ্গ ও বিশ শতকের নারী জাগরণ’-বিষয়ক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মুর্শিদাবাদ ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সহসভাপতি হাসিবুর রহমান। তিনি নূরজাহান মুরশিদের জন্ম, পরিবার পরিচিতি ও শিক্ষাজীবনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই বিদুষী নারী অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার তারানগর গ্রামে ১৯২৪ সালের ২২মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আয়ুব হোসেন বেগ ছিলেন লালগোলা থানার পুলিশপ্রধান। নূরজাহানের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল নিজের গ্রামের তারানগর এমই স্কুলে। লেখাপড়ায় শৈশব থেকে অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় লালগোলা ছেড়ে বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে আপার স্কুলিং সেকশনে – অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ, ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগের স্বর্ণপদক পেয়ে পাস করেন। কলকাতা ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়াকালীন অনেক প্রগতিশীল ব্রাহ্ম ও হিন্দু মহিলাদের জীবনধারা নূরজাহানকে গভীর প্রভাবিত করে। নূরজাহান কিছু সময়ের জন্য লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ভর্তি হয়েও ফিরে আসেন এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে সাম্মানিক স্নাতক হন। পরবর্তী জীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস কমিউনিকেশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করেন। সেখানে পিএইচডিতে ভর্তি হলেও তা সম্পন্ন করতে পারেননি।

হাসিবুর রহমান বলেন, নূরজাহান মুরশিদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আসন থেকে পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে আইন পরিষদের সচিব (পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি) হিসেবে কাজ করেন। সে সময় নির্বাচনে জয়ী হওয়া দুজন নারীর মধ্যে তিনি একজন। ১৯৬৭-৬৯ সালে ৬ দফা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৩ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। দলের এই সংকটে নূরজাহান মুরশিদ অত্যন্ত সাহস, দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর সামাজিক উত্তোলন ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি।

বেসরকারি সংগঠন উত্তরসূরির আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ ও গবেষক সোনিয়া নিশাত আমিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন উত্তরসূরির মহাসচিব ও ব্রতীর কর্ণধার শারমীন মুরশিদ।

আলোচকেরা বলেন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাঙা-গড়া, পাকিস্তান ও ভারতের ভাগ, মহান ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, এরপর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয়দফা, মুক্তিযুদ্ধসহ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এক উজ্জ্বল সাক্ষী ছিলেন নূরজাহান মুরশিদ। জীবনে একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙে আলোর পথে পা বাড়িয়েছেন নূরজাহান। দেশভাগের ক্ষত তাকে থামাতে পারেনি। ঢাকাতে পদার্পণ করে রেডিও পাকিস্তানে সঞ্চালক হিসেবে যোগদান করেন, পরে তিনি বিভাগীয় প্রযোজক হন। তিনি বরিশালের সাইদুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, ঢাকার কামরুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়, ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল ও হলিক্রস কলেজের মতো উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকতা করেন। রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলন, সাংবাদিকতা, সাময়িকপত্র প্রকাশ, বিভিন্ন নারী সংগঠন তার যাত্রাপথের বর্ণময় সরণি।

শারমীন মুরশিদ বলেন, আমরা স্মরণ করছি, নূরজাহান মুরশিদের সময়ের প্রজন্মকে। যারা তাদের মনন, আদর্শ, সমাজ দর্শন দিয়ে একটি জাতিকে তার পরিচয় দিয়েছেন। দেশভাগের পর একটি সৃজনশীল প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে ৫০-৬০ দশকে। পথিকৃত এই প্রজন্ম নতুন নির্মিত সমাজের ভিত হয়ে দাঁড়ায়। একটি নতুন দেশের জন্ম দেয় অর্থাৎ বাংলাদেশের।

।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট।।সোর্স লিংক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ