মুক্তিযুদ্ধ করেছি ঐক্য পরিষদ গঠন করার জন্য নয়: রানা দাশগুপ্ত

সারাবাংলা: ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান থাকলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনের প্রয়োজন হতো না বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

ঐক্য পরিষদের ৩৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার (২০ মে) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে এক আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। নগরীর লালদিঘী এলাকায় একটি কমিউনিস্টি সেন্টারে এ সভায় ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি ঐক্য পরিষদ গঠন করে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার জন্য নয়। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা লড়াই করেছি, এ বাংলাদেশের জন্য নয়। হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ গঠনের কোনো প্র‍য়োজন ছিল না। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর পার্লামেন্টে যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রচনা হয়েছিল, সেটার আওতায় যদি রাষ্ট্র পরিচালিত হতো, সেটা যদি বহাল থাকতো, তাহলে ঐক্য পরিষদ গঠনের কোনো প্রয়োজন ছিল না।’

‘কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, দেশ স্বাধীনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এ গণতান্ত্রিক সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক করা হলো। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর ১৯৮৮ সালের ২২ মে পার্লামেন্টে রাষ্ট্রধর্মের বিল উত্থাপন করলেন। আমরা দুইদিন আগে অর্থাৎ ২০ মে বিষয়টি জানতে পারি। সেদিন ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তৎকালীন সাংসদ সুধাংশ শেখর হালদারের বাড়িতে গিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করেন। একইদিন চট্টগ্রামেও ঐক্য পরিষদের কমিটি গঠিত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যেদিন পার্লামেন্টে বিলটি উত্থাপিত হল, সেদিন ঐক্য পরিষদের প্রথম সভাপতি মেজর জেনারেল সিআর দত্ত শহীদ মিনারের সমাবেশে বলেছিলেন, রাষ্ট্রধর্ম করার জন্য আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তারপর তৎকালীন সাংসদ শামসুল হুদার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।’

‘সেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল- এ সংবিধানে যদি রাষ্ট্রধর্ম সংযোজিত হয় তাহলে এদেশে ধর্মীয় কারণে যারা সংখ্যালঘু, তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। শিশুকাল থেকে তারা বিধর্মী হিসেবে জাতীয়ভাবে গণ্য হবে। তাতে লাভবান হবে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদ শক্তি, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। সংবিধানের এ সংযোজনের মধ্য দিয়ে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার ভয়ঙ্কর পরিণতি আমরা এখন দেখছি।’

বাংলাদেশ যাতে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত না হয় সেজন্য ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশ এমন একটি জায়গায় এসেছে, এখন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থাকবে না কি দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত হবে- এ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পুরো দেশ ও জাতি। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেই আমাদের সামনের দিকে পথ চলতে হবে। আমরা চাই না বাংলাদেশ দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত হোক।’

‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানের প্রতিচ্ছায়া কিন্তু সেদিন লক্ষ্য করেছিলাম। বর্তমান বিষয়টি তার চেয়েও ভিন্ন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা-বুদ্ধিজীবীরাও মুখে বলেন অসাম্প্রদায়িকতার কথা। কিন্তু চেতনায় সবাই সাম্প্রদায়িকতা লালন করে। এ সংকটে পড়েছে আজ বাংলাদেশ।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের দিকে একবার তাকান। ক্ষমতায় ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সংগঠন আওয়ামী লীগ। কিন্তু আজ রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রশাসনে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীদের দখলে চলে গেছে। এদের দখলে চলে যাওয়ার কারণে শুধু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে তা নয়, বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে তারা চ্যালেঞ্জ করছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, মানবিক বাংলাদেশের কথা বলে তাদেরকে টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে।’

‘সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ দেশটাকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। আমরা আন্দোলন করতে নেমেছি। এ আন্দোলনে আমরা মানুষের মাথা বিক্রি করতে চাই না। আন্দোলনের নামে ব্যক্তিস্বার্থে কিছু করাকে জঘন্য অপরাধ বলে মনে করি। আপনারা অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হোন। বৃহত্তর ঐক্যমোর্চা গড়ে তুলুন। সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে যারা মাঠে আছেন তাদের সাথী হিসেবে আমাদের রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, ‘একটি বটগাছ দিয়ে কখনও বাগান হয় না। বটগাছের পাশে ফল, ঔষধি গাছ থাকলে এর মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। ৩৬ বছর ধরে আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। এরপরও ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের আমরা রাষ্ট্রের দ্বিমাতাসুলভ আচরণ থেকে রক্ষা করতে পারিনি। হিন্দু ট্রাস্ট, বৌদ্ধ ট্রাস্ট করে আমাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে। সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় কিন্তু করা হয়নি। অথচ এটা আমাদের দাবি ছিল।’

কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামল কুমার পালিত বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের একটি অসাম্প্রদায়িক সংবিধান দিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর সে সংবিধান সংশোধন করার নামে বিকৃত করা হয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনের নামে আমাদের অধিকার হনন করা হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছে। আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। তবুও মন্দিরে হামলা হচ্ছে, হিন্দুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে।’

‘অথচ মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। যতদিন পর্যন্ত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা না হবে, ততদিন পর্যন্ত ঐক্য পরিষদের সংগ্রাম চলবে। যতদিন রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, অন্যান্য ধর্মের মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হবে, ততদিন ঐক্য পরিষদের প্রয়োজনীয়তা থাকবে। যেদিন সকল ধর্মের রাষ্ট্র হবে, সেদিন আর এ সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।’

ঐক্য পরিষদের মহানগরের সহ-সভাপতি আশুতোষ সরকারের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নিতাই প্রসাদ ঘোষের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- ঐশীপ্রেম ব্যাপটিস্ট চার্চের পুরোহিত থিয়ফিল এইচ চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আবু নোমান, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের আহবায়ক সুকান্ত দত্ত ও সদস্য সচিব রুবেল পাল, চসিক কাউন্সিলর নীলু নাগ ও রুমকি সেন গুপ্ত, মহিলা ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিনু দেবী এবং ছাত্র ঐক্য পরিষদের নগর সভাপতি অমিত পালিত অংকুর।

এর আগে সোমবার বিকেলে নগরীর চেরাগি পাহাড় থেকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের হয়।

।।স্বয়ংক্রিয় পোস্ট।।সোর্স লিংক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ