পারিবারিক বৈষম্যে নারী

রাজেশ কুমার কানু

নারীরা বৈষম্যের শিকার হয় জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি। কথাটা বিশ্লেষণ করা যাক।
মাতৃগর্ভ হতে একটি মেয়ে শিশু জন্ম নিলেই অনেকের মন খারাপ হয়। কেন ছেলে জন্ম হলো না৷
ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের সমাজে এখনো ছেলে শিশু জন্ম নিলে পরিবারের যে উছ্বাস বা আয়োজন হয় মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে তেমন হয় না। অস্বাভাবিক কিছুই না মেয়ে শিশু জন্ম নিলে মিষ্টির বাজেট কমে আসে।
ছোট বেলা থেকে একটা লোক কথা শুনতাম। মাছের মাথা খেলে নাকি বুদ্ধি বেশি হয়। (মূল বিষয় আসলে পরিমাণে বড়) এজন্য পরিবারে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ে থাকলেও মাছের মাথা সর্বদা ছেলেই পায়। কারণ মেয়েদের বুদ্ধির দরকার নেই। এজন্য সবাইকে ভালো অংশ দিয়ে মেয়েদের খেতে হয় লেজ। আমার মনে হয় সমসাময়িক সকল নারীই এই মাছের মাথা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমি নিজেও ছোটবেলায় মাছের মাথার ক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারি হয়েছি।
আমাদের সংস্কৃতিতে এমনও কিছু বিষয় আছে যেমন- স্বামী ভাত খাবার পরে কিছুটা ভাত আর তরকারি উচ্ছিষ্ট হিসেবে রাখবে আর স্ত্রীকে সেই প্লেটে স্বামীর উচ্ছিষ্ট সহ খাবার খেতে হবে। আসলে এটা কী বার্তা দেয়? স্ত্রীকে স্বামীর উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচতে হবে? এমন সংস্কার কী চরম অমানবিকতা নয়? কিছু ব্যক্তি আবার এক্ষেত্রে বলতে পারেন যে স্বামীর উচ্ছিষ্ট খেলে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। তাহলে কী স্বামীরও উচিৎ নয় স্ত্রীর খাবারের উচ্ছিষ্ট খাওয়া?
পরিবারের এমন আচরণ কিন্তু ছেলেকে আগ্রাসী করে তোলে। সে ভাবতে শেখে পরিবারে সেই কর্তা তার বোনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আর এসব কর্মকাণ্ড সেই মেয়েকে তখন থেকেই বোঝাতে শেখায়- তার কোনো কিছুতেই কোনো অধিকার নেই। তার জন্মই হয়েছে মাছের লেজ আর সকলের উচ্ছিষ্ট খাবার জন্য।
প্রচলিতভাবে যদিও বলা হয় বাবা মায়ের কাছে সকল সন্তান সমান। কিন্তু এই কথা শুধু কাব্যেই মানায়। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে কিন্তু বাবা মাও লিঙ্গভেদে তাদের সন্তানের সাথে বৈষম্য শুরু করে সেই শিশুকাল থেকেই।
প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবারা ছেলেদের জন্য যতটা করে মেয়ের জন্য করে না। মনোভাব এমন- মেয়েকে টাকা খরচ করে বিয়ে দিতে হবে৷ আর ছেলে তো বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসবে আবার কামায় করে খাওয়াবে।
এমন ভাবনার শিকার হয়ে মেয়েরা নিজের পরিবারে চরম বৈষম্যের শিকার হয়। এমন বৈষম্য কিন্তু চলতেই থাকে ঘটনাক্রমে। একটার পরে একটা। ছেলে বাবার কাছে হাত খরচের টাকা চাইলে তার জবাবদিহিতা থাকে না কিন্তু একটা মেয়ে পরিবার থেকে তার নৈমিত্তিক খরচের টাকা চাইলে কত যে জবাবদিহিতা আর বঞ্চনা তার শেষ নেই।
এবার আসি শিক্ষাক্ষেত্রে। পরিবারে ছেলে সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করার যে প্রয়াস থাকে সেই একই প্রয়াস কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এখানেও বৈষম্য।
ছেলেকে শিক্ষাসফরে যেতে দিতে হবে কিন্তু মেয়েদের কখনো না।
জীবনের এমন কোন স্তর নেই যেখানে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় বঞ্চিত নয়। এভাবে একটা করে উদাহরণ দিলে একটা মহাকাব্য রচনা করা যাবে।
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মেয়েরা আশ্রিতা, বঞ্চিতা। আর বর্তমানে যখন মেয়েরা পরাধীনতার শিকল ভাঙতে চাইছে তখনি কিছু পুরুষ প্রভুদের রাতের ঘুম হারাম।
তবে আমাদের হিন্দু সমাজে একটা ক্ষেত্রে কিন্তু মেয়েদের সবচেয়ে এগিয়ে রাখা হয়। আর সেটা হলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। বাড়ির নিত্যপূজা, বিভিন্ন উপাস, পূজা- এসবে শুধুমাত্র মেয়েদের অগ্রাধিকার। কিন্তু অন্য সবক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের বঞ্চিত করতেই থাকবে।
এই মানসিকতা থেকে সবাইকে বেড়িয়ে আসতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। নারীদের মানুষ ভাবতে হবে। নারীদের বঞ্চনার ইতিহাস পাল্টাতে হবে।
আজ সময় এসেছে নতুন ইতিহাস লেখার যেখানে নারীরা পরাধীন থাকবে না আশ্রিতাও থাকবে না।
লেখক: শিক্ষক ও সমাজকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ