পৃথিবীতে কয়েক হাজার ধর্মের মধ্যে খুব প্রচলিত ও সুপরিচিত কয়েকটা ধর্মের নিজ নিজ অনুসারীরা সব সময় দাবি করে তাদের ধর্মই শ্রেষ্ট,তেমনি নারীদের বেলায় ও তাদের দাবির জোর একই থাকে যে তাদের ধর্মেই নারীদের সম্মান বেশি দেয়া হয় ۔হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই যার যার দাবি ঠিক হতেই পারে ۔কিন্তু নারীর অধিকার কিংবা উত্তরাধিকার এর বেলায় সব ধর্মেই আবার একই সুর ۔কেউই আসলে এতটা উদার হতে পারেনি নারীদের ,মায়েদের ,বোনদের অধিকার দিতে ۔তারপর ও উপমহাদেশে সুপরিচিত প্রধান কয়েকটা ধর্মের তুলনা যদি চোখের সামনে দেখি হয়তো কিছুটা হলেও ধারণা আসবে আসলে কোন ধর্মে নারীরা কত বেশি সুরক্ষিত কিংবা বঞ্চিত অবহেলিত ۔
ইসলাম ধর্ম –মুসলিম পারিবারিক আইন : ইসলামে বাবা-মা ও স্বামী ও ছেলের সম্পত্তিতে নারীর অধিকার দেয়া হয়েছে। নারী পায় পুরুষের অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তি। স্বামীর সম্পত্তির ওপরও মেয়েদের ভাগ আছে। স্বামী সন্তান রেখে মারা গেলে স্ত্রী পায় ৮ ভাগের ১ ভাগ। আর সন্তান না রেখে মারা গেলে পায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। এমনকি ছেলে মারা গেলে ওই ছেলের নামে কোন সম্পদ থাকলে সেই সম্পদের 6 ভাগের 1 ভাগ পায় মা আর যদি ছেলের কোন সন্তান না থাকে তাহলে 3 ভাগের 1 ভাগ পায় মা ۔
অর্থাৎ কোন মুসলিম নারী যদি অবহেলিত নির্যাতিত বঞ্চিত লাঞ্চিত ও হয় তারপর ও তার মাথা গোজার ,নিজেকে রক্ষার জন্য আইনগত ভাবেই সে কিছু না কিছু পাওয়ার দাবি রাখে যেটার মাধ্যমে সে চাইলে নিজে নিজেই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে পারে ۔পাশাপাশি কোন স্বামী যদি তাঁকে ডিভোর্স দেয় তাহলে ও সে ভরণ পোষণ এর জন্য কাবিন নামায় উল্লেখিত টাকার দাবি করতে পারে ۔
সনাতন (হিন্দু )ধর্ম -হিন্দু উত্তরাধিকার আইন : বাংলাদেশে হিন্দু আইনে নারীকে ন্যূনতম সম্পত্তির অধিকারও দেয়া হয়নি। বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার নেই ,আছে জীবনীস্বত্ব নামক এক দীর্ঘশ্বাস ۔ মেয়েকে বিয়ের সময় যে উপহার (স্ত্রীধন,বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে যৌতুক হিসাবেই ধরে নেয়া হয় এবং যা রাষ্ট্রের ,সমাজের চোখে একটি অপরাধ ) দেয়া হয়, সেটিই মেয়ের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়। শুধু তাই নয়, বিয়ে বিচ্ছেদ বলে হিন্দু আইনে কিছু নেই। স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল হলে দুজন আলাদা থাকতে পারে,স্বামী আরো 2/4 টা বিয়ে চাইলে যে কোন সময় করতে পারে ۔স্ত্রীর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো সে আলাদা থাকতে পারবে কিন্তু কিছুতেই বিচ্ছেদ নয়।অন্য কাউকে সে বিয়ে করতে পারবে না ۔বলা যায় বিয়ে মানেই নারীকে স্বামীর কাছে পুরোপুরি সমর্পিত হতে হবে۔۔যেহেতু বিয়ের কোন রেজিস্ট্রি নাই তাই ডিভোর্স ও দেয়ার ক্ষমতা নাই ۔হিন্দু নারীর বিয়ে মানেই নিজেকে আমৃত্যু স্বামীর কাছে সমর্পিত হওয়া তা সে স্বামী যতই পরকীয়া করুক ,জুয়া খেলুক ,মাদকাসক্ত হোক , নির্যাতন অবহেলা করুক, তারপর ও মুখ বুজে সয়ে যাওয়াই ধর্মীয় শাস্ত্রীয় বিধান ۔পিতার সন্তান হয়েও ভাই পাবে কিন্তু বোন কিছুই পাবে না শুধু পাবে শাস্ত্রমতে কাগজে কলমে দেবীর সম্মান !!!
বৌদ্ধ ধর্ম -অহিংস কিংবা মানবতার ধর্ম হিসাবে পরিচিত বৌদ্ধ ধর্মেও নারীরা পুরোপুরি হিন্দু নারীদের মতোই অবহেলিত ۔রাষ্ট্রের আইন প্রণেতা রা পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন গুলো হিন্দু মুসলিম দের ক্ষেত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ও বৌদ্ধ কিংবা আদিবাসী উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ধারণাই পোষণ করে ۔ বৌদ্ধ সমাজ সাধারণত হিন্দু আইন মেনে চলে। তাদের আলাদা কোনো আইন নেই। এজন্য বৌদ্ধ ধর্মেও নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিয়ে বিচ্ছেদেরও উপায় নেই।পুরোটাই হিন্দু নারীদের কপি হয়েই জীবন যাপন করতে হয় আমৃত্যু ۔
খ্রিস্টান ধর্ম – উত্তরাধিকার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পায় ক্রিস্টান নারীরা ۔ খ্রিস্টান ধর্মে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমানাধিকার দেয়া হয় নারীদের : খ্রিস্টান ধর্মে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েরা সমান অধিকার পায়। আবার স্বামীর সম্পত্তিতেও স্ত্রীর অধিকার আছে। এই ধর্মে বিয়ের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন প্রথা চালু আছে। এখানে চার্চের ভূমিকাই প্রধান।
ক্ষুদ্র নৃ গুষ্টি /আদিবাসী/উপজাতি –
: ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের বেলায় সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ চলে নিজস্ব প্রথাগত নিয়মে। নির্দিষ্ট কোন কাঠামো নেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের ۔যে সব জনগুষ্টি তে মাতৃ প্রধান সমাজ ব্যবস্তা সেইসব মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থায় নারীরা বাবা ও স্বামীর সম্পত্তি পায়; যেমন গারো ও খাসিয়া নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। আর চাকমাদের মধ্যে পুত্র না থাকলেই কেবল কন্যারা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তির অধিকারী হয়।আরো যে সব গোত্র ওদের মধ্যে আছে ওরা ও নিজস্ব নিয়মেই সমাজ পরিচালিত করে ۔
তৃতীয় লিঙ্গ(হিজড়া )/প্রতিবন্ধী দের ক্ষেত্রে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে বঞ্চিত করা হয় এসব অবহেলিত জনগুষ্টি কে ۔হিন্দু ধর্মে তৃতীয় লিঙ্গ ,প্রতিবন্ধী ,পতিত ,দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পুরুপুরি বঞ্চিত হয় উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে যদিও একই বাবা মায়ের সন্তান ওরা ۔অথচ ওদের প্রাপ্য ওটা ۔
অন্যান্য ধর্মের পারিবারিক আইন এ তৃতীয়লিঙ্গ সন্তানদের বঞ্চিত করলেও ইসলাম ধর্মে ওদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু বিধান দেয়া আছে ۔ যেমন۔۔ কারো শারীরিক গঠন ও আচরণে পুরুষালি ভাব বেশি থাকলে পুরুষ হিসাবে এবং কারো শারীরিক যত্ন ও আচরণে মেয়েলি ভাব বেশি থাকলে মেয়ে হিসাবে তাদের কে উত্তরাধিকার সম্পত্তি দেয়ার কথা বলা আছে ۔যেটা অন্তত কিছুটা হলে মানবিক বলে মনে হয়۔
সব ধর্মেই দেখা যায় উত্তরাধিকার প্রশ্নে নারীদের প্রতি বৈষম্য অবহেলা ۔কোন ধর্মে কম কোন ধর্মে বেশি ۔এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি অবহেলিত হিন্দু নারীরা ۔ওদের তো উত্তরাধিকার প্রশ্নে কোন কিছু নাই বললেই চলে ۔ওরা ও যাতে সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে সেই জন্য বিদ্যমান আইন এ যে বৈষম্য গুলো রয়েছে সে গুলো সংস্কার করে ওদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার ওদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া পরিবারের ,হিন্দু সমাজের ,মানবিক হিন্দু সংঘটন গুলোর সর্বোপুরি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের ও দায়িত্ব তার নাগরিককে ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করা ۔۔
বাংলাদেশে হিন্দু বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনগুলো সংস্কার হোক ۔জয় হোক মানবতার ۔