লাভ জিহাদের অজুহাতে হিন্দু নারীর অধিকারে বাধা

Love zihad (‘লাভ-জিহাদ)’ শব্দটি এখন বেশ পরিচিত। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ভালোবেসে বা বিয়ে করে ধর্মান্তকরণ। যেহেতু ‘জিহাদ’ শব্দটি আরবীয় বা ইসলামী, তাই এটিকে মূলত: ভালবেসে ইসলামীকরণ বলা হয়,যদি ও এর মধ্যে কতটুকু ভালোবাসা আর কতটুকু ‘জিহাদ’ বলা মুশকিল। গত দুইদিন ধরে এই লাভ জিহাদ শব্দ টা আবার আলোচনায় আসছে চট্টগ্রাম এর পুষ্পিতা দাশ নামে এক হিন্দু মেয়ে যখন একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে। আমাদের ইতি চৌধুরী দিদি খুব সুন্দর একটা পোস্ট ও করেছে আজ। সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু মানুষের বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো আসলে এই লাভ জিহাদ টা কি,এটা কি আগে ছিল বা কি প্রেক্ষাপটে এই লাভ জিহাদ শব্দটার সূচনা একটু বুঝা দরকার।
লাভ জিহাদ প্রথম আলোচনায় আসে 2009-10 এর দিকে ভারতে যখন কিছু মুসলিম ছেলে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে। তখন এটা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় এবং পরবর্তীতে 2013-14 সালের দিকে এটা একটা আন্দোলনে রূপ নেয়,যেহেতু ইন্টারনেটের প্রচলন শুরু হয়েছে তাই সেই শব্দটা বাংলাদেশ সহ অন্য অনেক দেশে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় নেয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রেম করে ধর্মান্তর বা মুসলিম ছেলে বিয়ে করা কি এর আগে হয় নি? যদি হয়ে থাকে তাহলে এই লাভ জিহাদ নামে এই নতুন ঝড় কেন 2012-14 সালে জোরালো হলো? কারো মনে কি এই প্রশ্নটুকু এসেছে যখন মনসুর আলী খান পাতৌদি রবীন্দ্রনাথ এর নাতি শর্মিলা ঠাকুর কে বিয়ে করে তখন? কিংবা শাহরুখ খান -গৌরী,আমির খান,আরবাজ খান,আজহার উদ্দিন আরো শত নাম আছে ভারতে যারা মুসলিম হয়েও হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে। তখন কারো মনে কেন আসেনি লাভ জিহাদ শব্দটি? নাকি ওরা সেলিব্রেটি তাই ওরা করলে ওটা লাভ জিহাদ হবে না? হটাৎ কেন 2009-2014 লাভ জিহাদ এর আলোচনার সময় আসলো?
আসলো কারণ সাদা চোখে এটা কে আমরা মাথা মোটারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও যারা এই শব্দের জনক সনাতন প্রভাত নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা সাথে হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি,রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS)ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কোন না কোন ভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রিক ভাবনায় মত্ত ছিল। শেষ দুইটা সংঘটনতো খুব পরিচিত সবার কাছে এবং বর্তমান বিজেপি এর সহযোগী সংঘটন যারা বিশ্বব্যাপী এই শব্দ প্রচার এর দ্বায়িত্ব নেয়। যার সূত্র ধরে বাংলাদেশ,মায়ানমার সহ বিভিন্ন দেশে এটা ব্যাপক প্রচার পায়। আর আমরা বাংলাদেশী হিন্দুরা রা ভারতের ভালো জিনিস সহজে নিতে না পারলেও নেগেটিভ জিনিসগুলো খুব দ্রুত মাথায় নিতে পারি যেমন পেরেছি লাভ জিহাদ নিতে কিন্তু ওদের যে নারীদের উত্তরাধিকার আইন সংশোধন টা ওই ভালো কাজটা নিতে গেলে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে !!!
এখন আসি আরএসএস ঠিক ওই সময় কেন এতো জোরালো করলো এই প্রচার,শত বছর হতেই তো হয়ে আসছে ধর্মান্তকরণ? কারণ বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারছে না তখন ১০ বছর হয়ে গেলো? যেভাবেই হোক মানুষকে আকৃষ্ট করে ক্ষমতায় আসতেই হবে? 2004-2014 বিজেপি ক্ষমতায় নাই,সামনে নির্বাচন,মানুষকে বুঝাতে হবে আমরা হিন্দুত্ববাদী দল,হিন্দুদের পাশে আমরাই আছি,তাই লাভ জিহাদ কে ভোটের প্রচারণার অনেকটা নীরব কৌশল হিসাবেই ওরা বেছে নেয়,মানুষ গিলেও ফেলে ওই টোটকা,ফলশ্রুতিতে 2014 সালে বিজেপি ক্ষমতায়।
একটু ভাবুন তো? বাংলাদেশেও ভোটে জিতার জন্য,ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আকৃষ্ট করার জন্য এমন কোন ভারত বিরোধী কাজ কি বাকি রাখছে আওয়ামী বিরোধী দল গুলো যে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে আওয়ামীলীগ কে ভোট দিলে,মুসলমান রা সব হিন্দু করে ফেলবে এই সেই কত কি অপপ্রচার? কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার কারণে সেটা সম্ভব হয় নি কিন্তু বিজেপি ঠিক ই লাভ জিহাদ আর রাম মন্দির এর টোটকা কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস কে ঘায়েল করে দিলো। যদিও ওখানকার মুসলিম সংঘটনগুলো দাবি তুললো এসব অপপ্রচার শুধু ওদের দমিয়ে রাখার জন্যই করা হচ্ছে। বিভিন্ন আদালতের রায় এ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওটাই বলা হয়েছে যে মেয়েটা স্বইচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে,জোর করে করা হয়নি।
শুধু তাই নয় এই লাভ জিহাদ এর সুযোগ নিয়ে পাশের দেশ মায়ানমার ও ৯৬৯ অভিযান নাম দিয়ে আরাকান মুসলিম দের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায় সামরিক জান্তা এই বলে যে মুসলিমরা বৌদ্ধ মেয়েদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করতেছে। আরো বিভিন্ন ঘটনাবলী বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে জাস্ট এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট টা একটু বলি।
ভারতের অনেক সেলিব্রেটি র কথা আগেই বলেছি যারা মুসলিম পুরুষ কে বিয়ে করেছে তেমনি বাংলাদেশের ও কবরী,অঞ্জু ঘোষ,অরুণা বিশ্বাস,অপু বিশ্বাস,সুমিতা দেবী (জহির রায়হান এর স্ত্রী ) আরো অনেক আছে যারা অনেক আগেই মুসলিম ছেলে কে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছে কিন্তু তাদের বেলায় খুব একটা জোরালো প্রতিবাদ উঠেনি আমাদের হিন্দু সমাজ থেকে কারণ ওদের বলা সম্ভব না। তাছাড়া অনেক হিন্দু ছেলে ও মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়ে নওমুসলিম উপাধি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যার সংখ্যা কোন ভাবেই লাভ জিহাদ এর মেয়ের সংখ্যার চেয়ে কম নয়। ছেলে মুসলিম হলে ওটাকে লাভ জিহাদ এর পরিবর্তে কি শব্দ বলে আমার জানা নেই। তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু ওই রকম কোন প্রতিবাদ হতে শুনি না !!!
এরপর হটাৎ আলোচনায় আসে যখন হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ নারীদের বিভিন্ন বৈষম্য নিয়ে,নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে মাঠে নামে তখন কিছু কিছু লোক অপপ্রচার শুরু করে হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তি পেলে লাভ জিহাদ ধর্মান্তর বেড়ে যাবে,মুসলিম রা সম্পত্তির লোভে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে সব নিয়ে নিবে। অথচ ওরা জানে যে ধর্ম ত্যাগ করলে সেই মেয়ে আর কিছুই পাবে না,তারপর ও সহজ সরল হিন্দু দের এই বলে সেই বলে বিভ্রান্তের চেষ্টা থেমে নেই ওদের।
কিছু কাগজে কলমে শিক্ষিত লোক ও (যাদের আমি সার্টিফিকেট বা কাগজ ক্রেতা বলি ) না বুঝে সমান তালে তালি দিয়ে জল ঘোলা করে মাছ শিকার এর চেষ্টা করতেছে যাতে ওরা বিজেপি র সেই কৌশলের মতো হিন্দুদের আকৃষ্ট করার চেষ্টায় সফল হয়।
এই জন্যই লেখা টা কারণ কোন কাজ যদি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনায় আসে ওটা কে সব সময় সাধুবাদ দেয়া যায়,কিন্তু কোন সুবিধা আদায় বা কৌশল করে সংস্কার আন্দোলন কে ব্যাহত করার জন্য যদি কোন সময় এই লাভ জিহাদ এর ধুঁয়ো তোলা হয় সেটা কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমি নিজেও লাভ জিহাদ এর বিপক্ষে নই তবে ওটা যাতে ভিন্ন কোন খাতে চলে না যায় সেটার পক্ষে সব সময়। এই ধর্মান্তর রোধে হিন্দু আইন সংস্কার অনেক ভূমিকা রাখবে কারণ যে সব মেয়েরা যাচ্ছে ওরা ভাববে আমার সম্পত্তি রেখে আমি কেন চলে যাবো? এখন তো সেই পিছুটান নাই।
আর সবশেষে এটাই বলবো দোষ তো আসলে আমার নিজের ঘরের লোকের ই। আমরা যদি আমাদের বোনদের,কন্যা দের সঠিক শিক্ষা,মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিই,কোনটা ভালো কোনটা খারাপ এই বোধটুকু জাগ্রত করতে পারি তাহলে ওরা যতই যাই করুক আমাদের সমাজ নিরাপদ ই থাকবে। আগে নিজেদের ই ঠিক হতে হবে। সকল নারী তার অধিকার নিয়ে স্বাবলম্বী জীবন যাপন করুক, সকল অপকর্ম কে প্রতিরোধ করুক এই প্রত্যাশায়।
হিন্দু আইন সংস্কার চাই, হিন্দু নারীর সমঅধিকার চাই,মানবিক,কুসংস্কার মুক্ত,Love Zihad মুক্ত হিন্দু সমাজ চাই।

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ