শাশুড়ি মনোবৃত্তি

কৃষ্ণা গোলাপ: আমার মা একজন যথেষ্ট সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ। মডার্ন এবং প্রগ্রেসিভ। ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে যাওয়া আমাকে কখনো এ কথা না বলা একজন মা, মেয়ে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে এত খেলা কিসের! তবুও পুত্রবধূকে জিন্স পরে পাড়ায় বেরোতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বাড়ির বৌয়ের একটি মিডল ক্লাস অধ্যুষিত পাড়ায় এমন পোশাক পরা উচিত নয়, এই মর্মে আমাকে নালিশ জানাতে আসায় আমি কষে বকুনি দিয়েছিলাম মাকে। তারপরে মা নিজের ভুল বুঝুন না বুঝুন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আমি যদি সেদিন প্রথমেই কুড়ুলটা না মারতাম তাহলে পরবর্তী সময়ে একটি বিবাদমুখর কলতলায় পর্যবসিত হতো তাঁদের সংসার। সেটা আমি হতে দিইনি।

এই বকুনি দেওয়াটাই আসলে দরকার, যা দেওয়া হয় না বলেই শাশুড়িরা যথেচ্ছাচার করে যান। প্রচুর মা এমন থাকেন, যাঁদের চোখে নিজের কন্যার কোনও দোষ নেই, সব দোষ পুত্রবধূর বেলায়।

অনেকগুলো লেখা কালই পড়লাম।

বিয়ে নাকি এখন আর টিকছে না৷ যেভাবেই বিয়ে হোক, দুদিন পরেই বাই বাই। আসছে জন্মে আবার দেখা হবে।

হ্যাঁ, এমন দু একটা প্রতিবেদন কাগজে টাগজে বেরোনোর পর অধিকাংশ লোকের প্রতিক্রিয়া…

হবেই তো, হবেই তো। মেয়েদের আজকাল ডানা গজিয়েছে বলে কথা। মেয়েরা তো এখন কী স্বার্থপর কী স্বার্থপর… ( আহা দাবায়ে রাখতে পারা যায় না গ)

মেয়েদের সহনশীলতারই তো অভাব। মন্তব্যগুলো পড়লে মনে হয় পৃথিবীতে আজও মানুষ নেই, আছে শুধু কিছু নির্বোধ পুরুষ আর নারী।

সামাজিক নিয়মে একটি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়াই নিয়ম, আজকাল অনেকে শ্বশুরবাড়িতে থাকে না বলেই তো তাদের প্রচুর সমালোচনা, তাদের নিন্দে করে প্রচুর কাঁদুনি। ও মা গো, আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিল গো….

অথচ দিনের পর দিন নির্যাতন করতে পারেন শাশুড়ি। হ্যাঁ, ৪৯৮ এ আছে, কিন্তু সে তো চোখে দেখা যায়, এমন নির্যাতনের ক্ষেত্রে। যে সব নির্যাতনকে নির্যাতন বলে চেনা যায় না?

সেটাই কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার। অনেক মানসিক অত্যাচার, অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ প্রচ্ছন্ন থাকে, প্রকট হয় না। সেই কারণেই তা নিয়ে নালিশ জানানো খুব মুশকিল।

যেমন, বিয়ের পর থেকে ক্রমাগত বৌমার কাছে সন্তানের দাবি তোলা সমাজের চোখে নিখাদ আবদার হিসেবে গণ্য হয়। কবে নাতির মুখ দেখাবি বল। অথচ সেই আবদারই ধীরে ধীরে দাবিতে যখন পরিণত হয় তখন বৌটির উপর ভয়ংকর মানসিক চাপ পড়তে থাকে। শুধু শাশুড়ি নন, অনেক মেয়ের মাও এমন প্রেশার দেন অনবরত। শাঁখের করাতের এই চাপ বাইরে থেকে এতটাই নিরীহ যে এ নিয়ে ৪৯৮ এ ধারায় নালিশ জানানো যায় না। চাপ সইতে সইতে বৌটি কিন্তু ডিপ্রেশনেও চলে যেতে পারে। সন্তান চাওয়া না চাওয়ার অধিকার যে শুধু তাদের সে সব তো আমরা আবার মানি না মানব না। মহান ভারতীয় ঐতিহ্য।

না দেখতে পাওয়া এই অত্যাচারগুলোই আজকের স্মার্ট শাশুড়িদের স্ট্র‍্যাটেজি। তাঁরা দেখান নিজেরা আধুনিকমনস্ক, তাঁরা দেখান তাঁদের কাছে বৌমা একেবারেই বৌমা নন। বৌমা যেন কন্যা। ভুলেও তাঁরা পুত্রবধূকে ‘তোমার মা বাবা কিচ্ছুটি শেখায়নি’ জাতীয় সাবস্ট্যান্ডার্ড কথাবার্তা বলবেন না। সবেতেই দেখনদারি থাকে চরম, কিন্তু নিজের বাড়ির অনুষ্ঠান আর বৌয়ের বাপের বাড়ির অনুষ্ঠান একসঙ্গে পড়লেই তাঁদের স্বরূপ বেরিয়ে আসে। তখন প্রায়োরিটি দিতে জোর করেন শ্বশুরবাড়ির অনুষ্ঠানকে। বিদেশে দীর্ঘকাল বসবাস করা পোশাকআশাকে জবরদস্ত আধুনিক একটি পরিবারেরও ঠিক এমনই মনোভাব দেখে আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম।

যে হবু শাশুড়ি গোড়াতেই বৌকে চাকরি ছাড়ার পরামর্শ দেন, তার কাছ থেকে পালানো যায়। কিন্তু আজকালকার স্মার্ট শাশুড়িরা অনেকেই নিজের মনোবৃত্তিকে সুন্দর মোড়কে মুড়ে রাখতে জানে। প্রথমে তারা কিছুতেই আপত্তি জানাবে না। ভাবখানা এই, বৌ যেমনটা চায় সবই মেনে নেওয়া হবে। অথচ ধীরে ধীরে এরাই যাকে বলে ‘পোল’, তা খুলতে থাকে। প্রথমে বলবে, এত দূরে চাকরি করতে যাচ্ছ, তোমার খুব ধকল পড়ছে। কিছুদিন পর বলবে, আমার তো শরীরটা খুব খারাপ, তুমি বাড়িতে একটা দিন থাকলে ভালো হয়। এই আবদার বাড়তে থাকবে। বেশি কামাই করলে কোনো সংস্থা মেনে নেবে না। মেয়েটির অফিসে সমস্যা হতে থাকবে। কেরিয়ার বলে তার আর কিছুই থাকবে না।

মায়েদের কথাকে উড়িয়ে দিলেও শাশুড়ির কথাকে ওড়াতে পারে না মেয়েরা তাদের হাজবেন্ডের প্রতিবাদ না থাকায়। একটি মেধাবী মেয়েকে কেরিয়ার ভুলে যেতে বললে সে তো ডিপ্রেশনে যাবেই। অথচ এই অপরাধে শাশুড়িকে কেউ ৪৯৮এ ধারায় চার্জ করতে পারবে না।

এর বাইরেও থাকে অনেক কিছু। বাড়ির পুজোয় না চাইলেও থাকতে বাধ্য করা, ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে না দেওয়া, শরীরের তোয়াক্কা না করে ভোরে উঠতে বাধ্য করা, এ সবই জন্মগত অধিকার ভেবে নেয় শাশুড়িরা আর সমাজ এই ধারণাকে পরিপুষ্ট করে। আপাততুচ্ছ এই নির্যাতনগুলো একটি মেয়েকে সইতে হয় যেগুলোকে নির্যাতন বলে দাগিয়ে দেবার কোনো সুযোগ নেই।

আড়ালে থাকা এই নির্যাতনগুলোই শেষ করে দেয় মেয়েদের জীবন। এর থেকে মেয়েদের বাঁচানোর একমাত্র উপায় মা বাবার সহমর্মিতা। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল বলেই হাত ধুয়ে গঙ্গাচান করে এলাম, এমন মনোভাব আজও অধিকাংশ মা বাবার। তথাকথিত শিক্ষিত মা বাবাও চাকুরিরতা মেয়েকেও “মানিয়ে নে” বলতে পিছপা হননা। মেয়েদের উপর বিয়ের পরেও খবরদারি এবং বিয়ের পরে উপেক্ষা, এ দুয়ের যে কোনও একটিই মেয়েদের সুস্থ ভাবে বাঁচার পরিপন্থী।

হ্যাঁ তাই বলে শুধুই এটাই কারণ নয়। কারণ তো এটাও, একে অপরকে সম্মান না করা। আর তার জন্য অধিকাংশ সময়ে দায়ী থাকে বরবাবাজী, যে বাবা সারাজীবন স্ত্রীকে অসম্মান করেন তার ছেলে বৌকে অসম্মান করতেই শেখে। উল্টো ক্ষেত্রেও তাই হয়, অনেক মা মেয়ের কুশিক্ষার জন্য দায়ী, তবে স্বনির্ভর নয় যে সব মহিলা তাদের কথার আবার কেই বা অত দাম দেয়? স্বনির্ভর হলেও মেয়েদের কথার দাম বর ছেলে মেয়ে কেউই সাধারণত দেয় না, বললেও বয়েই গেছে শুনতে। তাই ডমিনেটিং বাবার কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত বরদের দ্বারা মেয়েদের উপর এই নির্যাতন বেশি চলে, হ্যাঁ অবশ্যই বেশি৷ সে আপনি মানুন আর না মানুন।

ফলত ডিভোর্স ছাড়া আর সমাধানই বা কী! নইলে হয় দুজনের একজন মরবে, নয় বেঁচে থাকবে জীবন্মৃত হয়ে।

হ্যাঁ মেয়েরা কেন জীবন্মৃত হয়েও সব সইবে না, কেন তাদের এত চোপা হবে, কেন তারা এএএএকটুও অ্যাডজাস্ট করবে না, এমন কথা বলার মতো mysogynist বদ লোকজন আজও কিছু কম নেই, কিন্তু তাদের কে পাত্তা দেবে আর কেনই বা দেবে? তাদের কানের গোড়ায় ঠা *টি *য়ে চ*ড় মা*রার মেয়েও তো এখন আর কম নেই।

সোজা কথায়, মেয়েরা আর পড়ে পড়ে প্রকট প্রচ্ছন্ন কোনোরকমের মার খায় না বলেই এখন ডিভোর্স হয় আর তা হতেই থাকবে। বিয়ে নয়, জীবন বেশি দামী, এ কথা ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে, এও কিন্তু কম সুখের নয়।

বৌমারাও অত্যাচারী হয়, এই মর্মে অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। অথচ কোনোভাবেই পুত্র আর পুত্রবধূকে আলাদা থাকতে দেবেন না, পণ করে বসে থাকেন কেউ কেউ। একই বাড়িতে তাদের থাকতে বাধ্য করবেন। নিজস্ব আলাদা সংসার চাওয়া কোনও অপরাধ নয়, সেটা হতে দিলে অত্যাচার করার কোনও চান্স নেই। দূরত্বই তো সেক্ষেত্রে সহজ সমাধান। কিন্তু তাহলে নিজেরা তো আবার খবরদারি করতে পারবেন না। তাই তা হতে দেন না শাশুড়িরা৷ বাধা দেন।

মানুষের স্বাতন্ত্র্য আর ব্যক্তিসত্তাকে সম্মান জানাতে শিখুক এ সমাজ। ওদের আগে সমাজ নিজেকে বদলাক। পান থেকে চুন খসবেই বা কেন, চুন খসা পান আপনি আমি খাব কি? মোটেও খাব না, পানওয়ালাকে আবার পান বানাতে বলব। চুন খসা সংসারই বা কেন উপায় থাকলে কেউ গলাঃধকরণ করবে? কেন? আপনি চাইছেন বলেই? মগের মুলুক?

সুতরাং… ডিভোর্স কেন ডিভোর্স কেন বলে না চেঁচিয়ে নিজেদের একটু আয়নার দেখা ভালো নয়?

*ফেসবুকে প্রকাশিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ