এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
‘জোর যার মুল্লুক তার’ এরকম নীতি অনুসরণ করে অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা সবলের দলে ভিড় জমিয়েছে এবং কোনো না কোনো গোষ্ঠী বা গোত্রভুক্ত হয়েছে। এই গোষ্ঠী বা গোত্রভুক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রথমত নিজেদের নিরাপদ করতে এবং দ্বিতীয়ত অধিকসংখ্যক মানুষ একটি গোত্রে সমবেত হয়ে অধিক শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে অন্য গোত্র বা গোষ্ঠীর উপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা তথা আমিত্ব প্রদর্শন করা এবং জোরজবরদস্তির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বলের সম্পদ লুটেপুটে নিজেদের ভা-ারে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে। বোধকরি তখনো শিক্ষা বিষয়ের সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটেনি। সবলের শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে তার চিন্তা-চেতনা এবং আনুগত্যের বাইরে যারাই থাকুক না, তারাই তাদের শত্রু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বের শুরু ঠিক এখানেই। এই গোষ্ঠীভুক্ত বা গোত্রভুক্ত হয়ে বাস করার ক্ষেত্রে সব গোষ্ঠীর মানুষই কোনো না কোনোভাবে তাদের মোড়লের মনস্তত্ত্বের বাইরে চিন্তা করার তেমন সুযোগ পায়নি। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রত্যেকটি গোত্রই তার নিজস্বতা চর্চা করতে গিয়ে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মত এক ধরনের সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল।
সময়ের পরিক্রমায় মানুষের চিন্তা-চেতনা, কর্ম পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকলে, বিশেষ করে মুদ্রা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত মূলত বিনিময় প্রথা তথা বার্টার ট্রেড অনুসরণ করে একে অন্যের পণ্য বিনিময় করে প্রয়োজন মেটানো হতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারণাকে কেন্দ্র করেও নানা রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটতরাজ, রাহাজানি কিংবা জোর-জবরদস্তির অজস্র ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তীকালে এক্ষেত্রেও এলাকাভিত্তিক সংগঠিত মানুষ একত্রিত হয়ে অন্য অংশের মানুষের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তারে যেমন ইচ্ছে তেমন করে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও একটি বিশেষ জোটের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে পরিপূরক ভাবনায় তারা অন্যদের গ্রহণ করতে পারত না। পক্ষভুক্ত সব মানুষের মনস্তত্ত্ব ছিল সাম্প্রদায়িক। যদিও বিষয়টির সঙ্গে তাদের শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান-গরিমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এমনকি, এ ধরনের মানসিকতা যে সাম্প্রদায়িক, সেই ধারণাও তাদের মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না।
শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা দ্বারা শিক্ষার আলোয় বিকশিত হতে থাকলে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে শিক্ষিত একটি অংশের মানুষের চিন্তাজগত ও মনোজগতে কিছু পরিবর্তন সাধিত হতে শুরু করে। নতুন এ ধারার মানুষগুলোর গোড়াপত্তন হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা যখন মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, ঠিক তখন থেকে। ধারাবাহিকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান বিভিন্ন শাখায় বিকশিত হতে থাকলে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষিত মানুষ দ্বারা বিকশিত হয়। জ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গনেই এটির একটি নির্দিষ্ট কাঠামো পেতে শুরু করে। এই শ্রেণির মানুষ দ্বারা নির্মিত জ্ঞানের কাঠামো, সমাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে আলো ছড়াতে থাকলে ভালোমন্দের পার্থক্য দ্বারা মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া শুরু হয়। একে অপরের শত্রু না হয়ে বন্ধু হয়ে বসবাস করার যে আনন্দ, এক ধরনের ভালো লাগা কিংবা প্রশান্তি তেমনটা মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করে। অশিক্ষিত মানুষের মনস্তত্ত্বেও কিছু পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। অস্ত্র লাঠির পরিবর্তে জ্ঞান গরিমার প্রয়োগ করে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে একে অন্যের সহায়ক হিসেবে সুন্দর করে জীবনযাপন সম্ভব, এমন ধারণাটি মানুষের মধ্যে যখন আস্থা অর্জন করতে শুরু করল, ততক্ষণে সমাজের বেশির ভাগটাই শিক্ষিত মানুষের পরামর্শ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে থাকল। বলে রাখা দরকার, শিক্ষার এই উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক ভাবনার বিস্তার ঘটতে অনেক বেশি সময় লেগেছে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রদায়িক শক্তি দ্বারা বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের অসুবিধায় তখনও পড়তে হয়েছে বারবার। যে সব দেশ যত বেশি দ্রুত তার শিক্ষার আলোকে প্রসারিত করতে পেরেছে, সে সব দেশের সাম্প্রদায়িক অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিকতা তত দ্রুত আলোকিত হয়েছে।
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিভিন্ন রকমের প্রকাশ রয়েছে। বিশ্বের যে সব ঘটনায় সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করেছে, সে সব প্রতিটি কাজের ধরন, চলন-বলন কিংবা কার্যসম্পাদনের প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রে একই রকমের নয়, বরং বিচিত্র। কখনো ব্যক্তি মানুষে-মানুষে, কখনো গোত্রে-গোত্রে, কখনো সমাজে-সমাজে, কখনো বর্ণে-বর্ণে, জাতিতে-জাতিতে, কখনো রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে, সর্বশেষ ধর্মে-ধর্মে এই রূপ বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার আধুনিক রূপের বিচিত্র প্রকাশ ঘটিয়েছে। বড় মারাত্মক রূপ এটি। অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর, যুদ্ধংদেহী। কখনো মৌলবাদ, কখনো জঙ্গিবাদ, কখনো তথাকথিত আদর্শভিত্তিক ধর্মাশ্রয়ী সংগঠনের অনুষঙ্গ, নানা রূপ পরিগ্রহ করতে পেরেছে এই সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি। এরা নিজের মতের বাইরে কোনো পৃথক মতের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে চলতে পারে না কখনই। পরিপূরক, সাম্য কিংবা সহাবস্থান কখনই সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি অভিযোজন করতে শেখেনি। আর এখানেই সাম্প্রদায়িক চরিত্রের সর্বোচ্চ সীমাবদ্ধতা। মারব না হয় মরব, তবু সহাবস্থানে বাস করব না, এমন নেতিবাচক চেতনা বা বিশ^াস দ্বারা পরিচালিত হয়। যদিও, কোনো ধর্মই এমনটা কাগজে কলমে বলে না। মানুষের সমাজবদ্ধ হওয়ার শুরু থেকে আজকের আধুনিক অভিযাত্রায় সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে বিলুপ্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কায় সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ জঘন্যতম রূপ ধারণ করেছে বর্তমানে এসে। সারা বিশ^ই কম-বেশি নতুন চরিত্রটি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
ঐতিহাসিক সত্য ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের শিকার হয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পৃথিবীতে এমন উদাহরণ সম্ভবত এটিই প্রথম, যারা সাম্প্রদায়িক অস্তিত্ব নিয়ে জন্ম লাভ করল। সারা বিশ্বে এমন ঘটনা সম্ভবত সত্যিই বিরল। সে সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিতের জন্ম হয়েছিল এবং রীতিমতো পণ্ডিত্যের প্রকাশ ঘটেছিল। এ রকম প্রেক্ষাপটে আমার ভাবতে খুব কষ্ট হয়, বিস্মিত হই এসব পণ্ডিত, শিক্ষিতজন অনেক পণ্ডিত্য অর্জন করলেও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দেশের জন্ম হচ্ছে এমন ভাবনাটিতে তারা কী করে এমন সিদ্ধান্তে একমত হয়ে গ্রহণ করতে পারলেন? এটির পরবর্তী পরিণতি কত বেশি ভয়ানক হতে পারে, যেখানে মূল ভারত ভূখণ্ডে অনেক মুসলিম মানুষের বাস, অন্যদিকে তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশে আজকের বাংলাদেশে অনেক বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস ছিল। সেদিন এই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিভক্ত না হলে অনিবার্য কারণে অন্য কোনো ফর্মুলায় দু’দেশের ভাগাভাগি হলে, ঐতিহ্যগতভাবে কেউই এই সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব এতটা প্রকট আকারে পেত না হয়ত। সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত খোদ ভারতকে যেমন করতে হয়েছে, হচ্ছে, তেমনি করে পাকিস্তান তো অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে দিন দিন।
বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিজাতিতত্ত্বের দুর্বলতা সঠিকভাবে অনুধাবনপূর্বক প্রাজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টির প্রয়োগ ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বে আঘাত হানার লক্ষ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের সংস্কৃতি পরিহার করে শুধু বাঙালি সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন। বাংলার মানুষের ভাষা রক্ষার আন্দোলন থেকে শুরু করে সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামে এই প্রগতিশীল চেতনার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং বারবার সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাজিত হতে থাকে। যদিও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনেক মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। সেই শক্তি আমাদের পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ক্রমশই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আমরা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে না গিয়ে সাম্প্রদায়িক মনস্তত্বের বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বলিয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করতে পেরেছি সত্য, কিন্তু যুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও পরাজিত অংশের সমর্থিত মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিলুপ্ত করতে পারিনি মোটেও। বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশের জনসংখ্যার যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদের নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বরং, আমরা পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারিনি সেই পরাজিত পরাক্রমশালী সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের হাত থেকে।
পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ একটি সরকারি কাঠামোতে সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব পাকাপোক্তভাবে বিকশিত হয়েছে। কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমকে আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিকত্ব প্রদান করতে দেখেছি। লজ্জিত হয়েছি রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা দেখে। দীর্ঘ ২০-২২ বছরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের অংশের জনসংখ্যা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিস্তার এত বেশি শক্তিশালী হয়েছে, বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ গড়ে তুলবে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি মোটেও। ফলে এত বেশি বৈষম্য তৈরি হয়েছে, অনুমান করে বলাই যায় বর্তমান কাঠামো পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাতেও ১০ জন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির বিপরীতে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে উঠছে না, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক তুলনাচিত্রে। বরং, যে সব প্রতিষ্ঠান থেকে আধুনিক শিক্ষিত প্রগতিশীল মনন এক সময় তৈরি হয়েছে এবং জাতি কিংবা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা যে ভূমিকা রাখতে পেরেছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসে বেছে বেছে সে সব প্রতিষ্ঠানকেও করায়ত্তে নেওয়ার কর্মকৌশল ও তার বাস্তবায়নে সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব যত বেশি পথ হেঁটে ফেলেছে, বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক প্রাতিষ্ঠানিক প্রসারতা বৃদ্ধি না পেয়ে বরং তত বেশি সংকুচিত হয়েছে, যার চিত্র আমরা পদে পদে অবলোকন করে যাচ্ছি।
ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিরা বাঙালির যতগুলো সফল আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে, তার সবক’টিতেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তেজস্বী ভূমিকা ছিল। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এতটাই ঋদ্ধ, যার প্রভাবকে ব্রিটিশ পাকিস্তানিরা রুখতে না পারলেও অসাম্প্রদায়িক বাঙালির এই চেতনাচর্চা বন্ধ করা না গেলে সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরতরে বাংলার মাটি থেকে বিদায় নিতে পারে, সে শঙ্কা থেকে পাকিস্তানিরা রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই একই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বে বিশ্বাসী শ্রেণি-গোষ্ঠী এদেশের সংস্কৃতি চর্চাকেই নির্মূল করার নানা পরিকল্পনা ও সংকল্প ঠিক করে দেশীয় সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এ ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের সমর্থন আদায়ের কাজটি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরেই করে আসছেন। প্রচার প্রসারে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে সরকারি সমর্থন কাজে লাগিয়ে বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সমর্থও হয়েছেন তারা। রমনার বটমূলে বোমা হামলা করে, সিনেমা হলগুলোতে বোমাবাজি করে ভীতি তৈরির মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস করে, একুশে আগস্ট বোমা হামলার মধ্য দিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করে, একযোগে সারা দেশে একসঙ্গে বোমাবাজির মধ্য দিয়ে জেএমবির শক্তিমত্তার প্রদর্শনী করে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হামলা চালিয়ে এবং হলি আর্টিজেনে জঙ্গি হামলা চালানোর মাধ্যমে আধুনিক সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের চূড়ান্ত রূপ তারা দম্ভভরেই প্রদর্শন করেছেন। সত্য মিথ্যা যাই হোক, কোনো কোনো ঘটনা আন্তর্জাতিক জঙ্গি কিংবা সাম্প্রদায়িক সংগঠনের দায় স্বীকার বা তাদের সঙ্গে আদর্শিক সম্পৃক্ততা আছে বলে দাবির কথাও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবরে উঠে এসেছে। তাদের এতকিছুর পেছনে যতগুলো উদ্দেশ্য রয়েছে, তার মধ্যেÑ বাঙালি সংস্কৃতির শ^াসরোধ করা অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, তারা অস্ত্রের চেয়ে বেশি ভয় পায় বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তিকে যা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে শক্তি জোগায় এবং রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করে বলেই ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের কাছে তারা এ কাজে বেশ শক্ত করেই গুরুদীক্ষা গ্রহণ করেছে। শাপলা চত্বর দখল করে সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র এবং সর্বশেষ জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি তথা জাতির পিতার চিন্তা-চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক দর্শন, ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করা ও সংবিধান অবমাননার শামিল। সেটিও খুব স্পর্ধার সঙ্গেই করে দেখাল তারা।
লাল-সবুজের বিজয় নিশানের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখবার লক্ষ্যে বাতিঘর হিসেবে যেটুকু আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন, তার সঙ্গে সংস্কৃতিকর্মী, মানবতাকর্মী, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা রাজনৈতিক কর্মী তৈরি করা খুব বেশি জরুরি। অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে তুলতে পারে এমন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে না দিলে অধিকসংখ্যক আলোকিত মানুষ সৃষ্টি করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি করে সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমেই কেবল সাম্প্রদায়িক অবস্থানের বিপরীতে ভারসাম্য আনয়ন সম্ভব। এই আলোকিত মানুষের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হলেই প্রধানমন্ত্রীর বাতিঘরের আলোর সঙ্গে পুরো বৃত্তের পরিধি পর্যন্ত অন্ধকার দূর করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোয় আলোকিত করা সম্ভব। সেই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা, জনগণকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার, যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করাও আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্য আগামী প্রজন্মের প্রগতিশীল গন্তব্যকে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে অধিকসংখ্যক সংস্কৃতিভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রসারের গুরুত্ব এখনই অনুধাবন করে বাস্তবায়ন আবশ্যক। মনে রাখা জরুরি, এত গভীর অন্ধকারের বিপরীতে অনেক বেশি আলোর চাষ করতে পারলেই কেবল সোনালি বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব।
লেখক পুলিশ কর্মকর্তা