আমরা জানি শিক্ষা আর মানবতা, নৈতিকতা মুদ্রার এপিট ওপিট। কারণ মানবতাবর্জিত ও নৈতিকতাহীন শিক্ষা মূলত কুশিক্ষাই বলা যায়। সাথে আছে ধর্ম। সব ধর্মের অনুসারীরাই একটাই দাবি তুলে থাকে ধর্ম মানবিকতা, নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, মনুষ্যত্ব জাগ্রত করে। দাবিগুলো আমার ভাষায় আংশিক সত্য আর বেশিরভাগই মিথ্যা। কারণ বর্তমান পৃথিবীতে যতগুলো ধর্ম এখনো টিকে আছে সবাই নিজধর্ম ছাড়া অন্যধর্মকে হিংসা করে, ঘৃণা করে, নিজেরটাই মানবিক অন্যটা অমানবিক ভাবে। তাহলে ধর্ম মানুষকে মানবিকতা শিখালো কোথায়?
শুধু অন্য ধর্মের কথা হলেও কিছুটা ছাড় দেয়া যায় কিন্তু নিজ ধর্মের ভিতর ও যখন এই হিংসা ঘৃণা, বৈষম্য ও অমানবিকতাকেই মূলধর্ম মানা হয়, জাত-পাতের দোহাই দিয়ে নিজ ধর্মের লোকদেরই অস্পৃশ্য করে রাখা হয়, নারী পুরুষকে শুধুমাত্র শারীরিক গঠনের কারণে নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হতে হয় ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধান এর দোহাই দিয়ে সেই ধর্ম কতটুকু মানবিক? কতটুকু নৈতিকতাপূর্ণ? আপনি যদি একজন চরম ধার্মিক হন আপনার কাছে এই প্রশ্নটা রইলো।
শিক্ষার কথাটা প্রথমেই আনলাম এই কারণে শুধু কাগজে কলমে শিক্ষিত হলেই শিক্ষিত বলা যায়না। সার্টিফিকেট না পেয়েও অনেক গুণীজন আছে যারা নিজেদের বিবেকবোধ দিয়ে অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন, আবার অনেকেই আছে বস্তা বস্তা কাগজ বগলে নিয়ে মগজের ভিতর হিংসা, বৈষম্য, অন্যের প্রতি ঘৃণা, অমানবিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের সমাজে শিক্ষিতের কাতারে দাঁড় করায়। প্রকৃতপক্ষে এসব কাগজ কুড়ানো শিক্ষা কুশিক্ষারই নামান্তর। যারা শিক্ষিতের লেবাস নিয়ে, ধর্মের লেবাস গায়ে জড়িয়ে মানবতাকে ভুলুন্টিত করে জাত পাত কে প্রশ্রয় দিয়ে নিজ ধর্মের লোকদের ঘৃণা করতে শেখায়, নারী পুরুষ বৈষম্যকে ধর্মের নামে সাপোর্ট করে অধিকারহীন, বঞ্চিত, অবহেলিত করে রাখতে চায়, তাদের এই শিক্ষা কি সুশিক্ষা নাকি কুশিক্ষা? যে ধর্মের নামে নিজের মা বোন স্ত্রী কন্যা কে ঠকানোর আইন খুঁজে, বর্ণ বৈষম্য লিঙ্গ বৈষম্য কে টিকিয়ে রাখতে রাস্তায় নামে সেই ধর্ম কতটুকু মানবিক? তাহলে কি ধর্মগুরুদের দাবি অনুযায়ী ধর্ম মানবিকতা শেখায় সেটা গ্রহণযোগ্য বলা উচিত? নাকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অমানবিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটা বলাই উচিত?
এই লেখায় শিক্ষা আর মানবিকতার সাথে ধর্মকে টেনে আনার কারণ হচ্ছে আমরা যখন নারী পুরুষের পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার চাই, হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করার দাবি তুলি বাল্যবিবাহ রোধ, স্বামীর বহুবিবাহ স্ত্রীর প্রতি অমানুষিক নির্যাতন ও যৌতুকপ্রথা বন্ধ করতে, কিংবা মাদকাসক্ত, দুশ্চরিত্র স্বামীর নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে বিবাহ বিচ্ছেদ আইন এর দাবি তুলি, পরিবারের অবহেলিত জন্মান্ধ, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, ক্লীব, বোবা, কানা, তৃতীয়লিঙ্গ ও পতিতদের পারিবারিক বা সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্টার কথা বলি, দত্তক হিসাবে ছেলে মেয়ে উভয়কেই দত্তক নেয়ার আইন এর দাবি করি, বাবা মা দুজনই অভিভাবক সন্তানের এই দাবি তুলি, তখনি কিছু কাগজ কুড়ানো শিক্ষিত দাবিদাররা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের বা শাস্ত্রীয় বিধান এর অজুহাত দিয়ে তাহলে ভালো কাজে যে শিক্ষা বাধা দেয়, নিজের মায়ের, স্ত্রীর, কন্যার, বোনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াতে যে শিক্ষা প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় সেই শিক্ষা কতুটুকু সুশিক্ষা? আর যে ধর্মের বা শাস্ত্রের নামে মানবিকতা কে পিষিয়ে মারতে চান, নিজের মা বোন স্ত্রী কন্যাকে অধিকারহীন রাখতে চান, সেই ধর্ম বা শাস্ত্রই কতটুকু মানবিক?
মানুষের আকৃতি ধারী সবাই আসলে মানুষ না। মানুষের যেই বৈশিষ্ট্য মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে সেটার নামই মানবিকতা, সেটাই তার মনুষ্যত্ব।
মানুষের প্রধান পরিচয় মনুষ্যত্ব। এই পরিচয়ে যে পরিচিত হতে পারল না, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, সে আসলে মানুষের মধ্যেই পড়ে না। পশুর সমতুল্যই থেকে যায়।
মানুষ জন্মগতভাবে একটি ধর্মে বিশ্বাসী হয়, কিন্তু সে যখন পরিপূর্ণ, বিবেকবান আর সভ্য মানুষ হয় তখন মানবিক ধর্মটাকে প্রাধান্য দেওয়াই যৌক্তিক বলে আমি মনে করি।
পরিশেষে বৈষম্যহীন, ভালোবাসাপূর্ণ একটা মানবিক হিন্দু সমাজ ই প্রত্যাশা করি যেখানে নারী পুরুষ, ভাই বোন স্ত্রী কন্যা সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে। কোনো জাত পাত থাকবে না, সবারই একই বর্ণ একই গোত্র থাকবে। যেখানে উপাসনালয়ে মানুষ স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মঙ্গলের প্রার্থনাই করবে। যেখানে অন্ধ, কানা, বোবা, তৃতীয়লিঙ্গ, দুরারোগ্য রুগী একই অধিকার সহানুভূতি পাবে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে পুরুষের বহুবিবাহ, স্ত্রীর নিরাপত্তা আর বাল্য বিবাহ বন্ধ ও যৌতুক প্রথা বন্ধ নিশ্চিত করবে। সেই মানবিক ধর্মের সমাজ ই প্রত্যাশা যেটা সম্ভব শুধুমাত্র প্রস্তাবিত ব্রিটিশ প্রণীত হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের মাধ্যমে। সকল বিবেকবান, সুশিক্ষিত, মানবিক ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন হিন্দু জনগোষ্ঠীকে এক হোক। হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার হোক, সুন্দর বৈষম্যহীন হিন্দু সমাজ হোক। বাংলাদেশের হিন্দু আইন সংস্কার চাই।