সুধীর সাহা
পেছন দিকে এগিয়ে যাওয়ার নাম প্রগতি নয়, উত্তরণও নয়। বরং একে পেছনে ফিরে যাওয়া বোঝায়। সংরক্ষণ কখনও একটু-আধটু ভালো ফল দিতে পারে। কিন্তু সংরক্ষণের বেশিরভাগটাই অন্ধকারে ভরা। এতে মেধার গৌরব রসাতলে যায়। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন মেধা নয়, প্রবণতা নয়, দক্ষতা নয়, চেষ্টা নয়, পরিশ্রম নয়- চাইলেই স্রেফ গলাবাজি করে এবং সস্তা অনুভূতি ছড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ জড়ো করে ফেলা যায়, তখন মেধার আপস নিয়ে সংরক্ষণের দিকে আঙুল ওঠে বৈকি!
সম্প্রতি কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ মাথার মোড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রায় সমাপ্ত স্থাপনাটির নাক-মুখ-চোখ ভেঙে ফেলা হয়। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার শহরে শহরে জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঢাকার দোলাইয়েরপাড়ে প্রধান দুটি সড়কের সংযোগস্থলে উঁচু একটি মঞ্চের ওপর জাতির পিতার ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের আলেমরা স্থাপত্যের পরিবর্তে মিনার তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন সরকারকে। সংগঠনের এক নেতা মামুনুল হক চট্টগ্রামের এক জনসভায় স্থাপত্যটি ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। তারপর তার পাশে দাঁড়ায় অন্যান্য কট্টরপন্থি সংগঠন। দেশের সব ভাস্কর্য ও মূর্তিকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তা ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়ে ঢাকাতে বিশাল সমাবেশ করেন তারা। ডিসেম্বরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়ের মাস হিসেবে উদযাপন করা হয় বাংলাদেশে। সেই ডিসেম্বরেই স্থাপত্য ভাঙার ঘটনা ঘটল কুষ্টিয়াতে। কুষ্টিয়ার স্থাপত্য ভাঙার পর হাইকোর্ট জাতির পিতার স্থাপত্য ও ম্যুরালের নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারকে।
এই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ প্রতিহত এবং প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক একটি শিক্ষা প্রচলিত আছে। এই শিক্ষা হলো জর্জি দিমিত্রভের সূত্রায়িত রাজনৈতিক একটি দীক্ষা, যেখানে তিনি ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার জন্য সমস্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী, এমনকি নরমবিরোধী বা দোদুল্যমানবিরোধীদের জোট গঠন করার পথনির্দেশ করেছেন। এ পথ ধরেই বলা যায়- মৌলবাদী ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগ, বাম দল, ডান দল, গণতান্ত্রিক শক্তির জোট সবাইকে একসঙ্গে জোটবদ্ধ হতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, একমাত্র গণতন্ত্র দিয়েই ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করা যায়। সেই সুরে যারা গণতান্ত্রিকভাবে সামনে এগিয়ে যেতে চায়, হোক সে আজকের বিরোধী রাজনৈতিক দল, সবার সঙ্গেই হাত মেলাতে হবে। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদকে তাড়ানোর জন্য নিজেদের ঘরের শত্রুতা তুলে রাখতে হবে সাময়িকভাবে। কেননা, এমন জোটই সমস্ত দেশের মৌলবাদী ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে দেশের বর্তমান সম্বল, ভবিষ্যতের ভরসা।
ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, সভ্যতা টিকে রাখার জন্য বহু ইতিবাচক বৈষম্য তৈরি করতে হয়েছে। নিপীড়িতদের জন্য এমন কিছু বিশেষ অধিকার তৈরি করতে হয়, যা সুবিধাপ্রাপ্তদের অধিকারের তালিকায় মোটেই থাকে না। এ বোধটা বহু সুবিধাপ্রাপ্তদের মনে তৈরিই হয় না। সে অবস্থাই চলছে বাংলাদেশে। এখানে ক্রমেই মেধাভিত্তিক সমাজ অসহায় চরিত্রে পরিণত হচ্ছে। তাই সময় এসেছে সমাজ, দেশ এবং সবার মঙ্গলের জন্য সংরক্ষিত কিছু ব্যবস্থার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করার ডাক দেওয়ার। মহিলাদের জন্য, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির গবেষকদের জন্য সংরক্ষিত স্বার্থের কথা ভাবতেই হচ্ছে কেন যেন! এ জায়গাগুলোতে লোলুপ চোখে তাকানো থেকে বঞ্চিত করতে হবে তাদের, যাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন অনধিকার প্রবেশ করার জ্ঞানটুকুও নেই।
তর্কের খাতিরে না হয় মেনেই নিলাম- বেশ বড় একটি সংখ্যারই দাবি ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে, মূর্তির বিরুদ্ধে। ধর্মের এক অমোঘ বাণীই হলো- ধর্ম ব্যক্তিচর্চার মাধ্যম। ব্যক্তিবিশ্বাস আর চর্চার মধ্যেই ধর্মের প্রচার, প্রসার সবকিছু। একটি রাষ্ট্র চলে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা। রাষ্ট্রের আইনে কোনো ভাস্কর্যের ক্ষতি করা আইনবিরুদ্ধ কাজ বৈকি! সে ব্যাপারে উস্কানি দেওয়াটাও প্রচলিত আইনবিরুদ্ধ। তাই কেউ নদীতে ভাস্কর্য ফেলে দেওয়ার কথা বললে তা হয়ে পড়ে আইনের বিরুদ্ধাচরণ করা। কেননা, দেশের প্রচলিত আইনে ভাস্কর্য গঠন করা বেআইনি নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু মুসলিম হলেও এখনও সেখানে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন আইনানুগভাবেই বসবাস করে। তারাও এ দেশের নাগরিক। তাদের নাগরিকত্ব বাতিল না করা পর্যন্ত এ গোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। যার যার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচরণ পালন করার সংবিধানপ্রাপ্ত অধিকার সব সম্প্রদায়ের প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে। সেই অর্থে, একজন হিন্দু অথবা সমষ্টিগতভাবে হিন্দুদের পূজা করার অধিকার বিদ্যমান আছে। তাদের বিশ্বাসে তারা মূর্তি তৈরি করে এবং তাতে প্রাণ সঞ্চার করে পূজা করে। হিন্দুদের গ্রহণ করব, দেশে থাকতে বাধা দেব না, কিন্তু মূর্তি সহ্য করা যাবে না- এমন বিপরীতমুখী বক্তব্য প্রদানের আইনগত অধিকার বাংলাদেশে কারও নেই। মুসলমানদের কাছে মসজিদ যেমনভাবে পবিত্র স্থান, হিন্দুদের কাছে মন্দিরও তেমনটাই পবিত্র স্থান। সেই মন্দিরে তারা মূর্তি তৈরি করতে পারবে, পূজা করতে পারবে- এ অধিকারটুকু সংবিধানই তাদের দিয়েছে। তাই ‘মূর্তি করা যাবে না, আমরা ভেঙে ফেলব’ এমন কথা বলার যুক্তিগত এবং আইনগত অধিকার কারও নেই।
একটি সভ্য দেশে নিঃশর্ত স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। জনবিশ্বাস এবং সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সামঞ্জস্য হওয়াটা জরুরি। মুসলমানদের নবী নিয়ে অথবা ইসলামের মূলনীতি নিয়ে অথবা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে অপমান করার স্বাধীনতা কারও থাকার কথা নয়। পাশাপাশি হিন্দুধর্মের বিশ্বাসের অপমান করার স্বাধীনতাও কারও নেই। মসজিদ যেমন পবিত্র, মন্দিরও তেমনই পবিত্র। এই সত্যতায় কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিতে পারে, তেমন আচরণ থেকে বিরত থাকার নামই সভ্যতা। উগ্রতা, সংঘাত ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তি এবং সহাবস্থানের জায়গায় পৌঁছতে না পারলে মানবিক উন্নতি সম্ভব নয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন- ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে। দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তিনি আরও বলেন- মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অত্যন্ত দিকনির্দেশনাপূর্ণ ছিল। তার বক্তব্যের কথাই হোক বিষয়ভিত্তিক শেষ কথা এবং আগামী দিনের মানুষের মনের কথা।
কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত মেজর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
ceo@ilcb.net