বাংলায় মুসলিম বিদ্রোহীদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন

গাজী তানজিয়া

ল্যাতিন শব্দ ‘ইম্পেরিয়াম’ থেকে ইংরেজি ‘ইম্পেরিয়ালিজম’ বা সাম্রাজ্যবাদ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ ‘সামাজিক কর্তৃত্ব’ হলেও সাম্রাজ্যবাদ বলতে বোঝায় কোনো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র বা জাতির ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তত্ত্বকে।

চার্লস বেয়ার্ডের মতে, কোনো একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের ভূখ- দখল করে তার ওপর দখলদারী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হলো সাম্রাজ্যবাদ। লেনিন বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের চূড়ান্ত রূপ। ১৮৭০ সালের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতিটি জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে উপনিবেশ বৃদ্ধি করে শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা করে। যদিও ইংল্যান্ড কর্তৃক ভারতবর্ষ তারও ১০০ বছর আগেই সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনে চলে যায়। এবং সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে তারা সেখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে।

১৭৫৭ সালে সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ শাসনের পত্তন ঘটে। তার কিছুকাল পর ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তনের ফলে বংলায় যে জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয় তারা এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরাই সরকারের আনুকূল্য পেয়ে সম্পদের মালিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকে। একটা শক্তিশালী ধনিক-বণিক শ্রেণিও এই সময়ে গড়ে ওঠে যারা সরকারের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে দেশের ব্যবসা-বণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতি। পক্ষান্তরে, কৃষি নির্ভর বাংলার সাধারণ মানুষ যাদের অধিকাংশ

কৃষক, জেলে, তাঁতি ও ক্ষেতমজুর অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি, যাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল, তারা ছিল নিরাপদ অবস্থানে। ১৮৭২, ১৮৮১ এবং ১৮৯১-তে যে আদমশুমারি হয় তাতে দেখা যায়, হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী হিন্দুদের তুলনায় এই ব্যবধানের পেছনে ছিল নানাবিধ কারণ।

১৮৫০ সাল পর্যন্ত বঙ্গের সাধারণ মুসলমানরা একেবারেই অন্ধকারে পড়েছিল। এই সময় পর্যন্ত তাদের যুগোপযোগী শিক্ষাও ছিল না। লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮৩৭ সালে সরকারি ভাষা ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি করায় তাদের আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। ইংরেজি না জানায় সরকারি চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা আগেও ছিল পশ্চাৎপদ। কারণ অভিজাত শ্রেণির কিছু মুসলমান ছাড়া বাকি সবাই ছিল মূলত কৃষিজীবী।

সংগত কারণেই বাংলার মুসলমানরা গোড়া থেকেই ইংরেজ শাসনের বিরোধী হয়ে উঠেছিল। পলাশীর যুদ্ধের পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান ফকির-সন্ন্যাসীরা সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত করেন যা ‘ফকির বিদ্রোহ’ ও ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে এই আন্দোলন পরিচালিত হয় মজনু শাহ্, ভবানী পাঠক, মুসা শাহ্, মাদার বকস প্রমুখের নেতৃত্বে। মুখোমুখি সশস্ত্র যুদ্ধে ১৭৮৭ সালে মজনু শাহ্ নিহত হন। মজনু শাহ্র ফকির বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায়ই ১৮৩২ সালে শেরপুরে পাগলপন্থিদের বিদ্রোহ শুরু হয়। শুধু ইংরেজ নয় তাদের দোসর এদেশীয় জমিদার, নায়েব, গোমস্তাদের বিরুদ্ধেও ছিল সেসব আন্দোলন।

বলাকী শাহ নামক একজন ধর্মীয় নেতার নেতৃত্বে ১৭৯২-এ বাকেরগঞ্জ জেলার প্রজারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মির্জা আগা মোহাম্মদ রেজা বেগ ইংরেজ বিরোধী দুর্জয় আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। এরপর আবির্ভাব ঘটে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের (১৭৮২-১৮৩১)। তার জন্ম ২৭ জানুয়ারি ১৭৮২। তিতুমীর ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িক। তিনি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুধু নয় কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজ নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তিনি শুরুতে ধর্ম সংস্কারে ব্রতী হন। ওহাবী আন্দোলন গড়ে তোলেন চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি এলাকায়। তারপর তিনি দরিদ্র কৃষক, তাঁতি প্রভৃতি শোষিত শ্রেণির মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে থাকেন। বিভিন্ন এলাকায় তিনি তাদের নিয়ে ইংরেজ নীলকর ও বাঙালি জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। নারকেলবাড়িয়ায় নির্মিত তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার সৈনিকদের হাতে ছিল দেশীয় কামারদের তৈরি অস্ত্র। উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনী তার আন্দোলন নস্যাৎ করে দিলেও তিনি শোষিত নিপীড়িত মানুষের মধ্যে সংগ্রামের বীজ বপন করে দিয়ে যান।

ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজি শরিয়ত উল্লাহ (১৭৮২-১৮৪০) এবং তার পুত্র মোহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬০) শুধু ধর্ম সংস্কার নয় ঢাকা ও বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দরিদ্র চাষি, তাঁতি ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করেন নীলকর-জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে।

শেষ পর্যায়ে (১৮৫৯-৬০) সালে হলো ‘নীল বিদ্রোহ’। এই নীলচাষ প্রতিরোধ সংগ্রামের নায়কও ছিল বাংলার শোষিত কৃষকরাই। ১৭৮৩ সালে রংপুরের কৃষকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নূরুল আল দীনের নেতৃত্বে। পাবনার কৃষক বিদ্রোহও (১৮৭৩-৭৫) ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বালগঙ্গাধর তিলক, চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহরু, জওয়াহেরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, সুভাসচন্দ্র বসু প্রমুখ যেমন নেতৃত্ব দেন, তেমনি তাদের পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মওলানা সোবহানী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী, মাহমুদুল হাসান, হাকিম আজমল খাঁ, এ কে ফজলুল হক, খান আব্দুল গাফফার, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ। তাদের মধ্যে মওলানা ভাসানী সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, সামাজিক অবিচার, অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে অন্তত ষাট বছরব্যাপী অবিচল ও অব্যাহতভাবে লড়াই চালিয়ে যান।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় নিপীড়িত জনগোষ্ঠীই বরাবর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতকে বঙ্গে যেসব আন্দোলন সংঘটিত হয় তার বেশিরভাগই নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় কৃষক সমাজ। জাতীয় পর্যায়ের বিখ্যাত নেতারা নন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গোড়ার দিক থেকে উপরোক্ত নেতাদের অবদান চিরস্মরণীয়। যদিও সাম্প্রদায়িক কারণে সবার নাম সমানভাবে সর্বত্র উচ্চারিত হয় না।

তথ্য সূত্র :

১. মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী : সৈয়দ আবুল মকসুদ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

২. উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা : ড. ওয়াকিল আহমদ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

৩. শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধান।

৪. S.Gertrude Millin, Rhodes, London.

লেখক : কথাসাহিত্যিক

বার্তা সূত্র

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ