রাজনীতি: সুইডেন বনাম বাংলাদেশ

রহমান মৃধা

আমি তখন স্কুলে পড়ি। বহু বছর আগের কথা। শুরু হল ইংরেজি ভাষা শেখার পালা। এখন ভাষা শিখতে হলে বিষয়বস্তুর ওপর কথা বলা শিখতে হবে। শিক্ষক নানা বিষয়ের ওপর আলোচনা করতেন। কোনো এক সময় রাজনীতি নিয়ে কথা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজনীতি কী? শিক্ষক বললেন, খুব সুন্দর প্রশ্ন। এসো এটা নিয়ে আলোচনা করি।

মনে কর তোমার বাবা পরিবার পরিচালনা করেন। তিনি পরিবারে সব ধরনের খরচ জোগাড় করতে আয়-রোজগার করেন। অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন পুঁজিবাদীদের প্রতিনিধি। সংসারের কোথায় কী খরচ হবে সেই সিদ্ধান্ত নেন তোমার মা। তার মানে তোমার মা হচ্ছেন সরকার।

তোমার বাবা-মা দু’জনে মিলে তোমার দায়িত্ব পালন করে, কাজেই তুমি হলে জনগণ। আর ধরো বাড়ির কাজের মেয়েটা, সে হচ্ছে শ্রমজীবী শ্রেণি। তারপর তোমার ছোট ভাইটা, যে কিনা এখনো ফিডার খায়, তাকে বলতে পারো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এখন এই লোকগুলোর মধ্যে সম্পর্কটা কী, সেটা প্রথমে খুঁজে বের করো। তারপর সেখান থেকে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে রাজনীতি জিনিসটা কী বুঝতে চেষ্টা করো; সবকিছু তোমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

স্যারের কথা শুনে আমি পড়লাম বিপদে। কেন যে জিজ্ঞেস করতে গেলাম! আমাকেই এখন উত্তর খুঁজে বের করতে হবে এবং ক্লাসে সেটা সবার সামনে ইংরেজি ভাষায় বলতে হবে। এতগুলো ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের জটিল হিসেব-নিকেশ মাথায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। কিন্তু চিন্তায় আমার ঘুম এলো না। সারা রাত বিছানায় ছটফট করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।

হঠাৎ ছোট ভাইটার কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। ছোট ভাইয়ের কান্নার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ছোট ভাই বিছানায় জলবিয়োগ করেছে, তাই কাঁদছে। বাবা-মা’র ঘরে ঢুকে দেখি, মা রীতিমত নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, কিন্তু পাশে বাবা নেই। বাবাকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম রান্নাঘরে- যেখানে কিনা বাড়ির কাজের মেয়েটা ঘুমায়!

সবকিছু দেখে-শুনে নির্বিকার চিত্তে ঘুম থেকে হুট করে উঠে আর্কিমিডিসের মতো ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলতে থাকলাম। মানে আমি সমাধান পেয়ে গেছি। পরদিন সকালে ক্লাসে সবার সামনে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললাম, রাজনীতি জিনিসটা কী, আমি বোধহয় মোটামুটি বুঝতে পেরেছি।

শিক্ষক বললেন, খুবই ভালো, এখন বলো কী বুঝলে? বললাম, পুঁজিবাদী সমাজ যখন শ্রমজীবী সমাজের ওপর শোষণ-অত্যাচার করে, সরকার তখন নাক ডেকে ঘুমায়। জনগণ সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তখন বাস করে নোংরা পরিবেশে!

গল্পটি আমি জানতাম অনেক আগেই কিন্তু মনে পড়েছিল সেদিন, তাই ইংরেজি ভাষা শিখতে কাজে লাগিয়েছিলাম। সে অনেকদিন আগের কথা। সত্যিকারার্থে রাজনীতি নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না। তবে রাজনীতি করে ক্ষমতার অপব্যবহার আর দুর্নীতি করার জন্য। রাজনীতি করে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে তার বাস্তব পরিপূর্ণতা লাভ করা যায় তার ওপর বাংলাদেশে বেস্ট প্রাকটিস হয়।

আমাদের সমাজে রাজনীতি বাপ-দাদা চৌদ্দ-গোষ্ঠীর পৈতৃক সম্পদে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি হয়েছে কাইন্ড অফ হেভি ইনভেস্টমেন্ট ইন্সটিটিউশন, যেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পদবি দখল করার প্রবণতা (যে কোন মূল্যে)। তারপর চলছে শাসন এবং শোষণ।

যদি দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঠিক চর্চা হত, যদি সু-শিক্ষা এবং মোড়াল ভ্যালু বলে কিছু থাকত বাংলাদেশে, তবে গণতন্ত্রের পতন হত বলে মনে হয় না। এখন যদি সত্যিকারে গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিস শুরু করতে হয়; তবে প্রথমত জানতে হবে রাজনীতি কী। দ্বিতীয়ত সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সেটা সম্ভব যদি আমরা সুইডেনের রাজনীতির পরিকাঠামো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফলো করি।

এখানে মোনার্কি থেকে ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের আবির্ভাব যা গোটা বিশ্বের জন্য জানা এবং শেখার বিষয়। এখানে রাজনীতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সুইডিশে যেমন, Politik betyder ursprungligen ‘statskonst’, och avser som regel alla de åtgärder och handlingar som hör till det allmänna livet, och inrymmer allt från diskussioner om offentliga angelägenheter till statlig verksamhet och organisation.

অর্থাৎ রাজনীতির মূল অর্থ ‘রাষ্ট্রীয় শিল্প’ এবং সাধারণত জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত পদক্ষেপ এবং ক্রিয়াকে বোঝায় এবং জনসাধারণের বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকাণ্ড এবং সংগঠন পর্যন্ত সমস্ত কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে।

রাজনীতি অর্থ ব্যবসা বা অনীতি নয়, রাজনীতি অর্থ সেবা দেয়া এবং সেটা জনগণের জন্য হতে হবে। জনগণ যাকে এ দায়িত্ব দিবে তাকেই সেটা পালন করতে হবে। কিন্তু হচ্ছে-টাকি আমাদের দেশে? একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদের কাছে রাজনীতি একটি পেশা এবং সেবা দেয়ার নেশা। তাদের মধ্যে থাকবে প্যাশন বা গভীর আবেগ। দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা এবং অনুপাত-সম্পর্কিত জ্ঞান।

রাজনৈতিক নেতার সামনে একটি ‘কারণ’ থাকতে হবে। তাকে শুধু ক্ষমতার জন্য বুভুক্ষু থাকলে হবে না। একজন নেতার থাকতে হবে নৈতিক মেরুদণ্ড এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা। এর সঙ্গে যখন বিচার করার যোগ্যতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা যুক্ত হবে, তখনই একজন নেতা ইতিহাসের চাকার দিক পরিবর্তনের সক্ষমতা অর্জন করবেন।

মহৎ উদ্দেশে নেতা হবেন বাস্তববাদী। এই কৌশলে দারিদ্র হ্রাসে মানব উন্নয়নে টেকসই বিনিয়োগ, নারীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং মানবাধিকার উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অন্তর্ভুক্ত করবেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহনশীলতা ও বিজ্ঞান সচেতন করে জনগণকে গড়ে তুলতে সব ধরনের সু-শিক্ষামূলক পদক্ষেপ নিবেন; যাতে করে আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি— একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার…।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে

বার্তা সূত্র

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ