মাজেদুল নয়ন
একজন নারীর কাছে কি কখনো জানতে চাওয়া হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর মানসিক বা শারীরিকভাবে তিনি কখনো আর সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কি-না? প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় এবং গণমাধ্যমের চর্চায় আমরা সেটা জানতে চাওয়াকে অপরাধ ভাবি বা এড়িয়ে যাওয়াটাই সময়োপযোগী ভাবি। তবে গবেষণা বা পুনর্বাসনের জন্য এই কথাগুলো জানার প্রয়োজন আছে।
২০১৯ সালের ২২ জুলাই একটি গণমাধ্যমে নোয়াখালীতে ধর্ষণের শিকার এক নারীর বয়ান উঠে আসে। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রায় সাত মাস আগে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এখনো সব সময় তার হাত-পায়ের মাংস ও হাড় ব্যথা করে। যন্ত্রণায় রাতে ঘুমোতে পারেন না। ডাক্তার দেখিয়েছেন, কিন্তু ওষুধে তেমন কাজ হচ্ছে না। সেই রাতে তার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন।
বর্ণনা শুনি বা না শুনি, ধর্ষণের শিকার একজন নারী যে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, যা তার মানসিক অবস্থাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়, সেটা অস্বীকার করা যায় না। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি অনুশোচনা, ঘৃণা এবং ক্রোধের মধ্য দিয়ে সময় পার করেন এবং যার প্রভাবে পোস্ট ট্রমাটিক সিনড্রোমে (পিটিএসডি) ভোগেন তিনি।
একটি ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে আমরা ধর্ষকদের বিচার দাবি করি, তাদের ওপর ঘৃণা বর্ষণ করি এবং দ্রুত বিচার, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুলি। তবে ভয় দেখিয়ে বা ঘৃণা করেই কি ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে? মনে হয় না। বরং একইসঙ্গে ধর্ষণের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে। এই অপরাধ থেকে আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যেমন চাই না কোনো নারী আর ধর্ষণের শিকার হোক, তেমনি একজন পুরুষ ধর্ষণ করার পূর্বেই তাকে আমাদের ফেরাতে হবে।
পশ্চিমে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, কেন একজন ব্যক্তি ধর্ষণ করে? তার উত্তরও এসেছে ভিন্ন ভিন্ন। ১৯৭০ সালে ৫০ জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আমেরিকান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. স্যামুয়েল ডি. স্মিথম্যান। তিনি মত দিয়েছিলেন, যে কেউ ধর্ষক হতে পারে। এই কথার মানে এই নয় যে, আশপাশের সবাইকে সন্দেহ করতে হবে বা ভয় পেতে হবে। এটার মানে হলো, কোনো নির্দিষ্ট গোত্র, বর্ণ, পেশা বা অঞ্চল দিয়ে ধর্ষককে চিহ্নিত করা যায় না। ধর্ষকদের পেছনের জীবনের গল্প যে কোনো কিছুই হতে পারে। যে কোনো সামাজিক অবস্থা, যে কোনো ধরনের ব্যক্তিত্ব বা মানসিকতার লোকই ধর্ষক হতে পারে। তবে তারা যখন ধর্ষণ করেছে, সেই সময়কার অভিজ্ঞতা শুনে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।
ধর্ষণে প্রভাবিত হওয়ার কারণগুলা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি সেগুলো পরিমাপ করাও দুরূহ। তবে গবেষণায় ধর্ষকদের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, সহানুভূতি বা সহমর্মিতার অভাব, মাদক বা নিজের প্রতি মুগ্ধতা এবং নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব দ্য সাউথের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ও গবেষক শেরি হ্যাম্বির মতে, যৌন নির্যাতন, যৌন তৃপ্তি বা যৌন আকাঙ্ক্ষার জন্য ধর্ষণ ঘটে না। বরং মানুষকে দমন করা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের ভাব থেকে ঘটে থাকে।
আমরা যদি দেশে সংঘটিত ধর্ষণের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এবং ধর্ষকদের চরিত্রগুলোর দিকে তাকাই, সেটির একটি প্রতিফলন দেখা যায়। ধর্ষকরা হয় ক্ষমতাবান দলের পরিচয় বহন করছে অথবা শিক্ষক বা ধর্মীয় গুরু। অথবা পরিবারের নিয়ন্ত্রক অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ বা ধর্ষণের সহকারী হিসেবে নাম উঠে এসেছে, তারাও ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে প্রভাব প্রদর্শনের ক্ষমতায় অন্তত একধাপ ওপরে রয়েছে।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একাডেমিক জার্নাল সাইকোলজি অব ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হ্যাম্বির মতে, পুরুষতান্ত্রিকতা প্রদর্শনের ভাব থেকেও ধর্ষণ হতে পারে। এই ধর্ষকদের অনেকেই যৌন সঙ্গমে সক্ষম নয়। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার প্রদর্শন করতে তারা যৌন নির্যাতন ঘটিয়ে থাকে। যেটা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রায়শই দেখতে পাই; যেমন ধর্ষণের পর নির্যাতিতার যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা বা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা।
অনেক সামাজিক এবং মনোবিজ্ঞানী ধর্ষণকে মানসিক বা আচরণগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করলেও, এটি যে ভয়াবহ অপরাধ সে বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। এমনকি গবেষকরা এটাও বলেছন, কিছু ধর্ষক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও, এমন কোনো মানসিক ব্যাধি নেই, যা কাউকে ধর্ষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই অপরাধীর বিচার হওয়াটা এক্ষেত্রে অন্য কোনো যুক্তিতে বাদ দেয়া যায় না।
বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞানী র্যান্ডি থর্নিল এবং বিবর্তনমূলক নৃবিজ্ঞানী ক্রেগ পালমার বিশ্বাস করেন, ধর্ষকের প্রথম চাহিদা ‘যৌনতা’ই থাকে। যে কোনো বয়সের নারী এবং মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হলেও দেখা যায়, ৮ বা ১০ বছর বয়সের ওপর থেকেই মেয়েদের ধর্ষণ করা হয় বেশি। যার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নারীরা যখন বাচ্চা নেয়ার অবস্থায় চলে যায়, তাদের ধর্ষণ করা হয় বেশি।
তবে তাদের এই আলোচনা বিশ্বজুড়েই নিন্দিত হয়েছে, কারণ বিবর্তনের ধারণার সঙ্গে যৌনতা আর ধর্ষণকে এক করে দেখেন না অন্যান্য গবেষক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ৪ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যেখানে আসলে উৎপাদনের বিষয়টি অনুপস্থিত। বেশিরভাগ সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং নারীবাদীই মত দিয়েছেন যে, ধর্ষণ হচ্ছে ক্ষমতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতার প্রদর্শন। এখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রণ করা এবং অবদমন করার মানসিকতা। মিশিগানের ওয়েইন স্টেট ইউনিভার্সিটির সামাজিক মনোবিজ্ঞানী অ্যান্টনি অ্যাবের মতে, ধর্ষকরা নারীকে একটি বস্তু হিসেবে মূল্যায়ন করে এবং তারা মনে করে, নারীর ‘না’ মানে তার পুরুষত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে এবং সে পুরুষত্ব ও ক্ষমতার প্রমাণ রাখতে চায়।
ধর্ষক কত ধরনের, সেটি নিয়েও রয়েছে নানা মত। এক ধরনের ধর্ষককে বলা হয় সুযোগসন্ধানী। যারা হয়তো একজন নারীর কোনো দুর্বলতার সুযোগ পেয়ে নিজেদের যৌন আকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং মাদকাসক্ত হয়ে ধর্ষণ করে। আরেক ধরনের হচ্ছে ধর্ষকামী ধর্ষক। যে কিনা ধর্ষণের শিকার নারীর কাছ থেকে অবদমিত হয়েছে বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ন ধর্ষকদের মধ্যে রাগ জমা থাকে এবং নারীর ওপর সরাসরি আক্রমণ করে। এই ধরনের ধর্ষকরা ভাবে, ওই নারীকে সে ধর্ষণ করতে পারে, কারণ সে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বা দুঃখ পেয়েছে। এছাড়া ক্ষমতার প্রদর্শন বা পুরুষতান্ত্রিকতার প্রদর্শনতো রয়েছেই।
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন, ধর্ষকরা সবসময়ই ধর্ষণের পর অস্বীকার করে এবং বিভিন্ন ধরনের যুক্তি উত্থাপনের চেষ্টা করে। তবে ধর্ষণ এমনই একটি অপরাধ যার কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না এবং এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে অনেক ধর্ষণের শিকার নারীই তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায় সম্পর্কে সমাজ এবং লোকের ভয়ে বলতেও পারেন না। অন্যদিকে ধর্ষকরা বীরচিত্তে অন্য কাউকে ধর্ষণের পাঁয়তারা করে বেড়ায়।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব অবশ্য নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ধর্ষণের ঘটনার পর দেশব্যাপী চলমান বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণকে আলাদা বা নতুন কোনো অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে রাজি নন। তিনি বলেন, এটা পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে এবং এখনো হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই হচ্ছে। কোনো একটি ঘটনা ঘটে গেলে ওই সময় সেটি নিয়ে কথা না বলে, সবসময়ই এটা নিয়ে কথা বলতে হবে, ধর্ষকদের প্রতিরোধ করতে হবে।
ধর্ষণের কারণ হিসেবে ব্যক্তির পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠা এবং অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে দায়ী করেন তিনি।
লেখক : সাংবাদিক, ফেলো, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ।