প্রভাষ আমিন
ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে অসাধারণ এক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল গত বছরের অক্টোবরে। স্বতঃস্ফূর্ত সে আন্দোলনের দাবির মুখে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু আমি আপনাদের বলে দিতে পারি, এ আন্দোলন এবং শাস্তি বাড়ানোর পরও ধর্ষণ কমেনি। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি ঘটনায় আলোড়ন তুললেও প্রতিদিনই গণমাধ্যমে ধর্ষণের খবর থাকে। ‘সাধারণ ধর্ষণ’ এর খবর এখন আর আমাদের ভাবায় না, কাঁদায় না। ‘অপ্রচলিত’ কিছু হলেই আমরা চমকে উঠি।
আমাদের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মধ্যবিত্ত নিয়ন্ত্রিত এবং মধ্যবিত্তশাসিত। আঘাতটা যখন আমাদের ঘরের কাছে, পরিচিত কারও ওপর পড়ে, তখন আমাদের গায়ে লাগে। আমরা ধাক্কা খাই, চমকে যাই। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করি না, মৃত্যু পর্যন্ত গেছে বলে, একটি ঘটনা সামনে এসেছে বটে, তবে অবক্ষয়টা দীর্ঘদিনের। এখন ধসে পড়ার অপেক্ষা।
আমরা ধর্ষিতার নাম-পরিচয় প্রকাশ করি না, তাকে ধর্ষণ পরবর্তী সামাজিক হেনস্তা থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু মাস্টারমাইন্ডের ছাত্রী আনুশকা সব হেনস্তার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। তাই তার নাম লুকিয়ে আর লাভ নেই। কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিক দেখলাম অভিযুক্ত ধর্ষক, ফারদিন ইফতেখার দিহানের নামও গোপন রাখছে? কেন? এটার যুক্তি হতে পারে, অভিযুক্ত মানেই তো অপরাধী নয়। খুব ভালো যুক্তি। কিন্তু এই যুক্তিটি কিন্তু তারা সবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে না। দিহানের ক্ষেত্রেই তারা সাংবাদিকতার উৎকর্ষের প্রয়োগ ঘটাতে চাইছে। এটি আসলে ভালো সাংবাদিকতা নয়, এটি অপরাধীকে বাঁচানোর অপচেষ্টা মাত্র।
এটা ঠিক, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই মিডিয়া ট্রায়াল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। প্রমাণিত হওয়ার আগেই মিডিয়া অভিযুক্তকে অপরাধী বানিয়ে দেয়। মিডিয়া ট্রায়াল প্রসঙ্গটি ভিন্ন। সেটি নিয়ে আরেক দিন আলোচনা করা যাবে। তবে সবার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতাটা একইরকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। দিহানের ক্ষেত্রে আলাদা হলে সেটা সন্দেহ সৃষ্টি করে।
শুধু গণমাধ্যম নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অভিযুক্ত ধর্ষক ও খুনি দিহানকে বাঁচানোর একটা অপচেষ্টা দেখা যায়। শুধু দিহান নয়, ধর্ষকদের বাঁচানোর একটা অপচেষ্টা আমাদের সমাজে প্রচলিত। পুরুষ মানুষ এমনই হয়, এই যুক্তিতে ধর্ষণকে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হয়। ধর্ষকের বয়স কম হলে বলা হয়, বয়সের দোষ; বেশি হলে বলা হয় ভীমরতি। এভাবেই পুরুষদের দায়মুক্তি দেয় আমাদের সমাজে। সবচেয়ে খারাপ যেটা হয়, সেটা হলো ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে। বাংলাদেশে অনেক জায়গায় ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়েকে সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচার ভাবা হয়। কোথাও কোথাও পুলিশ, এমনকি আদালতও ধর্ষকের সাথে ধর্ষকের বিয়ের অনৈতিক কাজে সহায়তা করে।
আনুশকা সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু তারপরও দিহানকে বাঁচাতে আনুশকাকে দোষী প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। সে বন্ধুর বাসায় কেন গেল, এটা নিয়ে সবার মাথাব্যথা। বন্ধু বন্ধুর বাসায় যাবে, এটা তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা। বাসা খালি থাকলে চার-পাঁচ বন্ধু মিলে সেখানে আড্ডা দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু সেই চার-পাঁচজনের মধ্যে একজন যদি মেয়ে বন্ধু হয়, তাহলেই তাকে ধর্ষণ করতে হবে? আসলে নারীদের সম্পর্কে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।
নারীকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। রাস্তায়, শপিংমলে, বাসে, ট্রেনে অবশ্যই নারীকে সাবধান হতে হবে। মাথায় ধর্ষণের ইচ্ছা নিয়ে অনেক পুরুষ ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই বাজেভাবে ছুঁয়ে দেবে। কিন্তু তাই বলে বন্ধুর বাসায়ও একজন নারী নিরাপদ হবে না? আমরা পুরুষরা যদি এমন হায়েনার মতো আচরণ করি, নারী দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি; তাহলে তো নারীদের বন্দি থাকতে হবে। তাহলে সমাজ-দেশ এগোবে কীভাবে? ধর্ষকদের খাচায় বন্দি রাখতে হবে। যাতে নারীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারে।
দিহানকে বাঁচানোর জন্য অনেকে বলার চেষ্টা করছেন দিহান এবং আনুশকার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তারা কতবার কথা বলেছেন, কতবার দেখা করেছেন, কী চ্যাটিং করেছেন; তাও এখন অনেকের গবেষণার বিষয়। আমি সবই সত্য বলে ধরে নিচ্ছি। দিহান এবং আনুশকার যা বয়স, সেটা প্রেমেরই। কিন্তু প্রেম করা আর পাশবিক নির্যাতন করে প্রেমিকাকে মেরে ফেলা এক নয়।
অনেকে বলছেন, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। এটা সত্য হলেও দিহানের অপরাধ কমবে না। কারণ আনুশকার বয়স ১৭। অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ সম্মতি দিলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। ধরে নিলাম শুরুটা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই হয়েছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে নিশ্চয়ই মেয়েটি বাঁচার চেষ্টা করেছে, বাধা দিয়েছে। কিন্তু প্রেমিক থেকে পশুবনে যাওয়া দিহান তা মানেনি। ময়নাতদন্ত বলছে, মেয়েটির যোনীপথ এবং পায়ুপথ- দুদিকেই রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভাবা যায় দিহান ছেলেটি কী রকম দানব হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর আগে আনুশকা দেখে গেছে বন্ধুরূপী, প্রেমিকরূপী পুরুষের ভয়ঙ্কর চেহারা।
আরেকটা কথা আমরা ভুলে যাই, সঙ্গীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা। নারীর পোশাক, নারীর হাসি, নারীর চাহনিকেই আমরা সম্মতি ধরে নিয়ে সুযোগ পেলেই ধর্ষণ করার চেষ্টা করি। নারীর সম্মতির বিষয়টা ভাবিই না। একটা বিষয় পরিষ্কার, না মানে না। এমনকি পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক শুরুর পরও যদি নারী না করে, সেটাও অবশ্যই না এবং সাথে সাথে পুরুষটিকে থেমে যেতে হবে। সম্মতির বিষয়টি শুধু বন্ধু বা প্রেমিকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, পেশাদার যৌনকর্মীরও অসম্মতি জানানোর অধিকার আছে। এমনকি বিবাহিত স্ত্রীরও অসম্মতি জানানোর অধিকার আছে। আপনার স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করলে, সেটাও কিন্তু ধর্ষণ। তাই দিহান আর আনুশকার মধ্যে সম্পর্ক ছিল কি ছিল না, তাতে কিন্তু দিহানের অপরাধের মাত্রা একটুও কমে না। আপনার প্রেমিকাকে আপনি ভালোবাসতে পারবেন, কিন্তু তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে পারবেন না।
প্রেম একটি পবিত্র বিষয়, যৌনতাও। একটা বয়সে যৌনতা সবারই চাহিদা, সে চাহিদাটা যেমন পুরুষের, তেমনি নারীরও। নারী-পুরুষের পারস্পরিক শারীরিক আকর্ষণটাও স্বাভাবিক। এখানেই সৃষ্টি, এখানেই সভ্যতার বিকাশ। মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেরা। তাই তাকে কিছু নিয়ম-কানুন, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা মানতে হবে। প্রেম যেমন পবিত্র, স্বর্গীয় হতে পারে; যৌনতাও তেমনি হতে শৈল্পিক ও সৌন্দর্যময়। তাই যৌনতা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে তো হতে হবেই, মাথায় রাখতে হবে পারস্পরিক আনন্দের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। আপনি যা করছেন, তা আপনার সঙ্গী উপভোগ করছেন কিনা, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
কিন্তু আমরা শুধু পুরুষের আনন্দ বা উপভোগের বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করি। নারী যেন শুধু ভোগের বস্তু, পুরুষের কামনা মেটানোর যন্ত্র। একজন পুরুষ নারীর সাথে প্রেম করে ছলে-বলে-কৌশলে-বুঝিয়ে-ফুসলিয়ে বিছানায় নেয়ার জন্য। সুযোগ পেলে প্রেমিকাকে বিছানায় নেয়াই যেন প্রেমের লক্ষ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন না বদলাবে, যতদিন নারী-পুরুষ সম্পর্কটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার না হবে, যতদিন প্রেম ও যৌনতাটা পারস্পরিক সম্মতি ও আনন্দের না হবে; ততদিন এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বাসা খালি পেলে প্রেমিক হয়ে যাবে ধর্ষক।
যতদিন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক হবে না, ততদিন আইনের কঠোর প্রয়োগই শুধু নারীদের কিছুটা নিরাপদ রাখতে পারে। আমরা দিহানসহ সব ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাজা চাই। ছেলেটির বয়সের দোষ, মেয়েটি কেন গেল; এসব কুযুক্তি দিয়ে যেন আমরা ধর্ষককে রক্ষার চেষ্টা না করি।
লেখক, সাংবাদিক