ধর্ষণের ফাঁদ পাতা ভুবনে পরিবারের কর্তব্য

সুদীপ্ত সাইফুল 

রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী আনুশকা নুর আমিন ধানমন্ডির বাসা থেকে বেরিয়ে কলাবাগান এলাকায় বন্ধু ফারদিন ইফতেখার দিহানের বাসায় যান দেখা করতে। সেখানে কী হয়েছে, এ ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখি, অচেতন আনুশকাকে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান দিহান। চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, দিহানের সঙ্গে আনুশকার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। নিহত ছাত্রীর পরিবার বলছে, তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে।

এ ঘটনাটিসহ প্রায়শই ঘটে চলা ধর্ষণ কিংবা যৌন সন্ত্রাস সম্পর্কিত অঘটন ও হত্যাকাণ্ড অভিভাবকদের না ভাবিয়ে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিপরিচিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু, এমনকি নিকটাত্মীয়রাও ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। নিজ বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, গণপরিবহনে, পর্যটন কেন্দ্রে, ভাড়া বাসায়, প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারসহ সর্বত্রই ঘটছে এমন জঘন্য ঘটনা।

কিছুদিন আগে ‘বিয়ের প্রলোভনে’ ধর্ষণ বেশি আসত সংবাদমাধ্যমে; সম্প্রতি বেড়েছে ‘বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে’ ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ছেলে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে নবম শ্রেণির তিন ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। এর আগের বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। ‘ফেসবুক বন্ধুর সঙ্গে’ বেড়াতে গিয়ে তিন স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ‘দলবদ্ধ ধর্ষণে’র শিকার হয় এক তরুণী। একই বছরের ৬ অক্টোবর নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে দশম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৯ সালের ৯ জুন বরিশালের হিজলায় বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয় এক তরুণী। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ২০২০ সালে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়া তরুণীর সংখ্যা শতাধিক।

সংবাদমাধ্যমের খবর বিশ্নেষণে দেখা যায়, বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের বয়স ১৩ থেকে ২০ বছর। অধিকাংশই স্কুলপড়ূয়া। আর ধর্ষণে অভিযুক্তদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। বেশকিছু ঘটনার সঙ্গে কথিত প্রেমের সম্পর্ক থাকার সূত্র পাওয়া যায়। মূলত তরুণীদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে বিকৃতমনারা। তাদের লক্ষ্য থাকে পাশবিক নির্যাতন। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে মেয়েদের স্কুলে যাতায়াতের পথে ওঁৎ পেতে বসে থাকে তারা, সহায়তা নেয় তরুণীর কোনো বন্ধু বা স্বজনের। এর সঙ্গে থাকে মানসিক ব্ল্যাকমেইল ও চাকচিক্যময় মিথ্যাচার। এর ফলে অনেক তরুণী পরিবারের বাইরে তার কথিত প্রেমিককে নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এই সুযোগে বিকৃতমনারা পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। তাতেই থেমে থাকে না; ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে রাখে ধর্ষক। পরবর্তী সময়ে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দীর্ঘদিন নির্যাতন অব্যাহত রাখে। বিষয়গুলো জানাজানি হলে তারা ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে অর্থ দাবি করে ভিডিওর ভয় দেখিয়ে। অনেক সময় তারা ধর্ষণের পর হত্যা করে, আবার অনেক ক্ষেত্রে লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগীদের অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

শুধু যে এভাবেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তা কিন্তু নয়। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে বন্ধুত্ব এখন ডাল-ভাতের মতো। কাউকে কোনোদিন না দেখে, কারও সঙ্গে কোনোদিন কথা না হলেও গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বের সূত্রে দেখা করার আবদারের বিষয়টি সামনে আসে। এই আবদার নিয়ে মাসের পর মাস ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে সামাজিক মাধ্যমে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকা ধর্ষকেরা। কথিত মেয়ে বন্ধু কোনোদিন দেখা করতে গিয়ে পা দেয় পাতা ফাঁদে।

অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য, আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সোচ্চার নয়। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের লক্ষ্য করে বানানো ভিডিও প্রদর্শনীতে নেই কোনো সেন্সর ব্যবস্থা। এ ছাড়া ধর্ষণের সব খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে না। চাঞ্চল্যকর দুই-চারটি ঘটনা মানুষ জানতে পারে। অধিকাংশই ধামাচাপা পড়ে কথিত মানসম্মান, গ্রাম্য সালিশ কিংবা প্রভাবশালীদের প্রভাব-প্রতিপত্তির চাপে। ধর্ষণের সঙ্গে কিন্তু পুরুষালি মানসিকতা ও ক্ষমতার একটা যোগসূত্র বিদ্যমান। হুমকি-ধমকি কিংবা সামাজিক হেয় থেকে পরিত্রাণের ভয়ে অধিকাংশ ঘটনায় চাপা দিতে বাধ্য হয় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। আবার যদি কেউ থানায় অভিযোগ করে, সেক্ষেত্রে মামলা নিতে গড়িমসি দেখা যায়। কোনোভাবে মামলা হলেও আসামিরা গ্রেপ্তার হয় না। ফলে বছরের পর বছর গেলেও বিচার পায় না ভুক্তভোগী।

সব দল, সব ধর্ম, সব আদর্শের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে ধর্ষকরা। সুতরাং ধর্ষণ থামাতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারের দায় সবচেয়ে বেশি। সন্তানরা কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব পর্যবেক্ষণ করা অভিভাবকের অবশ্য কর্তব্য। সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা তাদের সবকিছু অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। সন্তানদের এ সম্পর্কিত বিষয়গুলো বোঝাতে হবে। কেউ বিপথগামী হলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ