বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্র!

তালেব রানা: যুক্তরাষ্ট্রে গত ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে দেখা হচ্ছিল দেশটির ইতিহাসে অন্যতম বিভক্তির নির্বাচন হিসেবে। কারণ গত চার বছরে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তার সময়ে, তার সমর্থনে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে গত ১১২ বছরের মধ্যে গড়ে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তিনি ট্রাম্পের চেয়ে ৭০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে ৭ কোটিরও বেশি ভোট পেয়েও পরাজিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে বোঝা যায়—কতটা বিভক্ত হয়ে পড়েছে এখনকার যুক্তরাষ্ট্র।

এই বিভক্তির চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে গত বুধবার। ঐ দিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেসের ভবন ক্যাপিটলে নজিরবিহীন হামলা ও সহিংসতা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ঐ দিন কংগ্রেসের দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করে জো বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণার কথা ছিল। কংগ্রেসের দুই কক্ষের আইনপ্রণেতাদের উপস্থিতিতে অধিবেশনও শুরু হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইছিলেন এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে। তিনি সমর্থকদের ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে বলেন। ক্যাপিটলে হামলার জন্য উসকানি দেন! সমর্থকরা ক্যাপিটলে হামলা করার কয়েক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ভিডিও বার্তায় তাদেরকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। একদিন পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না।

ইতিহাসবিদরা বলছেন, ১৮৬৯ সালের বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং আজকের দিনে ট্রাম্প সমর্থকদের সহিংসতার মধ্যে শক্ত সাদৃশ্য রয়েছে। ক্যাপিটলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের উপস্থিত না থাকার ঘোষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে এত তীব্র বিভক্তি এর আগে দেখা যায়নি। সর্বশেষ ১৮৬৯ সালে ক্ষমতাসীন একজন প্রেসিডেন্ট তার উত্তরসূরির অভিষেক অনুষ্ঠানে যাননি। এই অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রেসিডেন্টের উপস্থিত থাকাটা মার্কিন রাজনীতির একটি বড় ঐতিহ্য।

যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার বিলুপ্তি নিয়ে ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলে। দেশটি গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্রান্ডন রটিংসহস বলেন, বর্তমান সময়ে একই ধরনের বিভক্তি এবং রাজনীতির ধারা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন যিনি ট্রাম্পের মতোই বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি প্রতিনিধি পরিষদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অভিশংসিত হন এবং সিনেটে রক্ষা পান। তিনি প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস এস গ্রান্টের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না। গ্রান্ট ১৮৬৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হন।

আব্রাহাম লিঙ্কন নিহত হওয়ার পর জনসন প্রেসিডেন্ট হন। যিনি কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকারকে অগ্রাহ্য করেন। তিনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং দুর্দশার রাজনীতি সৃষ্টি করেছিলেন। অন্যদিকে গ্রান্ট ছিলেন ইউনিয়ন আর্মির বিজয়ী জেনারেল, যিনি ‘কনফেডারেসি’কে পরাজিত করেছিলেন। তিনি এখনকার বাইডেনের মতো ছিলেন। যাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। যিনি দেশকে একত্রিত করেছিলেন।

গ্রান্টও জনসনের সঙ্গে মেলামেশায় রাজি ছিলেন না। এমনকি অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন একই ঘোড়ার গাড়িতে করে হোয়াইট হাউজ থেকে ক্যাপিটলে যেতে অস্বীকৃতি জানান। সেদিন অভিষেক অনুষ্ঠানে জনসন না গিয়ে সমর্থকদের নিয়ে বড় সমাবেশ করেন। দিনটি ছিল ৪ মার্চ। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ১৯৩৩ সালে ২০তম সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ ও ক্ষমতা গ্রহণের দিন ২০ জানুয়ারি করা হয়।

ফ্লোরিডার রিপাবলিকান সিনেটর রিক স্কট ট্রাম্পকে শপথ অনুষ্ঠানে না যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে আহ্বান জানিয়েছেন। স্কট কংগ্রেসে বাইডেনের জয় ঘোষণার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। তবে তিনিও বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। যা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি আমাদের দেশ ও বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।

৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনা গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেরেমি সুরি আলজাজিরাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে দুষ্কৃতকারীদের সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যদিও আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করি না। তিনি ৬ জানুয়ারির আগ্রাসনের সঙ্গে ১৮৭৩ সালে লুইজিয়ানার ‘কলফ্যাক্স ম্যাসাকার’ এর মধ্যে সাদৃশ্য দেখছেন। যখন শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়ারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গভর্নরকে উৎখাত করে এবং ১০০ কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসকে হত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটি ছিল বর্ণবাদী ও রাজনৈতিক সহিংসতার সবচেয়ে বাজে অধ্যায়।

অধ্যাপক ব্র্যান্ডন রটিংসহস বলেন, ক্যাপিটলে এ ধরনের আগ্রাসন খুবই বিরল ঘটনা। আর একজন প্রেসিডেন্ট এতে উসকানি দিয়েছেন সেটি আরো বিরল। এই হামলায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদেরকে ‘থার্ড-রেট পাওয়ার’ মনে হচ্ছে, যাদের রাজধানী অরক্ষিত এবং গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_img
spot_img

বাছাইকৃত

বিশেষ নিবন্ধ